বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » পর্যটন » দৃষ্টিনন্দন ঝরনা জাদিপাই

দৃষ্টিনন্দন ঝরনা জাদিপাই 

মোরশেদ ইকবালঃ   দৃষ্টিনন্দন ঝরনা হিসেবে জাদিপাইয়ের সুনাম রয়েছে। পাঠক হয়তো বলবেন, ঝরনা সব সময়ই দৃষ্টিনন্দন! কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ঝরনা রয়েছে যেগুলো নিজ বৈশিষ্ট্যের কারণেই ভ্রমণপিপাসুদের মন ভরিয়ে দেয়। জাদিপাইয়ের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়। নইলে বেশ কয়েক বছর ধরেই এই ঝরনার নাম অভিযাত্রীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে কেন? আর এমন একটি ঝরনা আছে জানতে পেরে আমরাই বা ঘরে বসে রইব কেন? সুতরাং পরিকল্পনা হলো জাদিপাই দেখার।
বর্ষা ছাড়া নাকি ঝরনা দেখায় সুখ নেই। কথা সত্যি। ঝরনা দেখতে হলে তার যৌবনটাই দেখা উচিৎ, তাই বর্ষাকাল ঝরনা দেখার উপযুক্ত সময়। কিন্তু বর্ষা তো আর থেমে থাকার নয়! পরিকল্পনামাফিক অভিযান শুরু হলো আমাদের। প্রথমে জিং সিয়াম সাইতার যাব, তারপর সেখান থেকে  জাদিপাই। এই পথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো বহুল পরিচিত বাংলাদেশের এক সময়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডাং। এক সময় কেওক্রাডাং দুর্গম মনে হলেও এখন কিন্তু আর তা মনে হয় না। বর্তমানে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। অভিযাত্রীরা এখন হামেশাই সেখানে যাচ্ছেন। সুতরাং প্রায় বছরজুড়েই দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে কেওক্রাডাংয়ের পথ। শীত মৌসুমে রুমা বাজার থেকে সরাসরি চান্দের গাড়িতে যাওয়া যায়। ফলে অনেকে বৌ-বাচ্চা নিয়েও সেখানে যাচ্ছেন। মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের অনবরত লুকোচুরি খেলা, কখনও কখনও দর্শনার্থীর শরীরে মুহূর্তেই শীতল পরশ- এই সাধপূরণে, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে টানাপোড়েন থাকায় শহুরে মধ্যবিত্তের অনেকে চাইলেই দার্জিলিং, চেরাপুঞ্জি যেতে পারেন না। তাই গত কয়েক বছর হলো কেওক্রাডাং হয়ে উঠেছে তাদের এই সাধপূরণের স্থান

jodipai
তবে এই পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা যে হচ্ছে না, তা নয়। অতিমাত্রায় পর্যটকের চাপ রয়েছে (বিশেষ করে শীত মৌসুমে) কিন্তু এর বিপরীতে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। দর্শনার্থীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও খাদ্যের উচ্ছিষ্টে বিনষ্ট হচ্ছে পাহাড়ি প্রকৃতির নির্মলতা। অতি উৎসাহী কিছু দর্শনার্থীর কারণে ক্রমেই সৌন্দর্য হারাচ্ছে এখানকার প্রকৃতি। শুধু তাই নয়, পাহাড়ের মানুষের সহজ সরল মানসিকতাও এদের কারণে বদলে যাচ্ছে। তারা আমাদের সম্পর্কে একটা  ভুল ধারণা পাচ্ছে। কারণ ওরা যেভাবে হৃদয় দিয়ে প্রকৃতি আগলে রাখে আমরা সেভাবে অনেক সময় ভাবিও না। কেওক্রাডাংয়ের চূড়ার সামান্য নিচে গড়ে উঠেছে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর আবাসিক হোটেল। ফলে বোঝা যায়, কেওক্রাডাং হয়ে উঠতে যাচ্ছে ব্যবসার একটি অন্যতম জায়গা!যাই হোক, জিং সিয়াম সাইতার দেখে রাতে থেকে গেলাম সুনসংপাড়া। চমৎকার একটি ঘুমের পর সকালেই ছুটতে হলো মাথার উপরের পাশিংপাড়া হয়ে জাদিপাই অভিমুখে। এই পথে পাশিংপাড়ার নিচে কানানপাড়া। অপেক্ষাকৃত নতুন বসতি, অনেক নিচে উপত্যকার মতো একটি সমতল জায়গায় ছিল তাদের পূর্বনিবাস। কোনো এক অজানা রোগে প্রায় ৪৫ জন মানুষের মৃত্যু হলে তারা জায়গা পরিবর্তন করে চলে আসে উপরে। ভারাক্রান্ত গলায় দুঃখের কথা জানালেন কারবারী কানান। রীতি মোতাবেক পাড়ার নামকরণ হয়েছে কারবারীর নামে।  যাত্রা বিরতিতে তার ঘরে উপস্থিত হলে খুব আপ্যায়ন করলেন। তার আতিথ্য চিরদিন মনে রাখার মতো। শুধু তাই নয়, অর্ধেকেরও বেশি পথ তিনি আমাদের সঙ্গ দিলেন এবং ঝরনায় যাওয়ার বাকি পথ দেখিয়ে বিদায় নিলেন। পাহাড়ের মানুষ অতিথিকে যথাসাধ্য সেবা, সম্মান করতে ব্যাকুল হন, জাত-পাত কোনো ভেদ করেন না।
অথচ মাত্র এক দিন আগের অভিজ্ঞতাকে পাশে দাঁড় করালে দুয়ের মাঝে তফাত পরিলক্ষিত হয়। জিং সিয়াম সাইতার দেখে ফেরার পথে রুমনাপাড়া সেনাক্যাম্পের নিকটে এসে ইফতারের সময় হয়ে গেল। ক্যাম্প কমান্ডারের আহ্বানে তাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিলাম। ইফতার সামনে নিয়ে সকলেই বসে আছেন, ইফতারের একটু আগে আমাদের গাইডকে আলাদা একটি পাত্রে খানিক ইফতার দিয়ে বলা হলো, এই নাও, তুমি ওদিকে সরে গিয়ে খাও। ভদ্রলোক পেশাদার কোনো গাইড নন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। নেহায়েত খাতির হয়ে ওঠার কারণে আমাদের সাথে গিয়েছিলেন। ইফতার সকলেই খাচ্ছেন, আর সামান্য দূরে বসে অপমানে, অবহেলায় মলিন মুখে তিনিও খাওয়ার চেষ্টা করছেন। না খেলে যদি কোনো অন্যায় হয়ে যায়! এই ভেদ সমতলের বাঙালিদের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।নিচের দিকে কেবল নামছি আর নামছি, পথ ফুরাবার লক্ষণ নেই। ভাবছিলাম, ফেরার পথে এতো উঁচুতে আবার উঠব কেমন করে! অথচ স্থানীয়রা পিঠে ঝুরি ভরে আদা, হলুদ নিয়ে উঠে যাচ্ছে স্বভাবিকভাবে। একেকটি ঝুরির ওজন কত হতে পারে? জানতে চাইলে উত্তর শুনে মাথা ঘুরে গেল। প্রতিটি ঝুরির ওজন ত্রিশ থেকে চল্লিশ কেজি! তারা ভীষণ পরিশ্রমী, ফসল উৎপাদন করে প্রচুর পরিমাণে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে সঠিক মূল্য থেকে তারা বরাবরই বঞ্চিত হয়।
এবার খানিক সমতলের পর পৌঁছে গেলাম জঙ্গলে ঢাকা স্যাঁতস্যাতে পথে। এরই মধ্যে জোঁকের উপদ্রপ বেড়ে গেল। পায়ে ভালোভাবে কেরোসিন মেখে জঙ্গলের নিচ দিয়ে মাথা, কোমর হেলে নামতে নামতে এক পর্যায়ে পথ ফুরালো। চোখের সামনে বিশাল ঝরনা- জাদিপাই! গলগল করে ঝরছে, দেয়ালে আছাড় খেয়ে সাদা ধবধবে পানি ছড়িয়ে পড়ছে বড় একটি জায়গাজুড়ে। নিচে সৃষ্টি হয়েছে একটি গর্ত, যেখানে নেমে ঝরনার পানিতে সহজেই গা ভেজানোর সাধ মিটিয়ে নেয়া যায়। চোখ স্থির করে তাকালে দেখা দেয় একাধিক রংধনু। ঝরনায় সৃষ্ট বাষ্প আর সূর্যের আলোর ব্যাঞ্জনায়  রংধনুগুলি অনবরত আকাশের বুকে ফুটে ওঠে। আর তা দেখে ছুঁয়ে যায় প্রকৃতিপ্রেমী অভিযাত্রীর হৃদয়। আর জাদিপাই ঝরনার গান- সে তো আরো মনোমুগ্ধকর!

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone