বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিশেষ সংবাদ » নান্দনিক রূপ হারাচ্ছে ‘হাতিরঝিল

নান্দনিক রূপ হারাচ্ছে ‘হাতিরঝিল 

 রোকন উদ্দিনঃ  লেকের পানি আগের মতো স্বচ্ছ নয়। ময়লা আবর্জনা পড়ে লেকের পানি অস্বচ্ছ ও নোংরা আকার ধারণ করেছে। পানি থেকে বেরিয়ে আসছে বিকট গন্ধ। চারদিকে অবৈধ বিলবোর্ডে ঢাকা। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে করা হয়েছে বিবর্ণ। ফুলের বাগান শুকিয়ে গেছে। রাতে আলো ছড়ানো লাল নীল বাতির অনেকগুলোই বিকল। আর এভাবেই নান্দনিক রূপ হারাচ্ছে ‘হাতিরঝিল’

hatir

২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি চালু হওয়ার পর অব্যবস্থাপনা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাত্র ২২ মাসেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার এক টুকরো সৌন্দর্য হাতিরঝিলের অপরূপ। এছাড়া নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সরঞ্জাম, চুরি হয়ে গেছে ময়লা ফেলার অনেক ড্রাম ও সড়ক বাতি।সরেজমিনে দেখা গেছে, হাতিরঝিলে চারপাশ ঢেকে আছে অবৈধ বিলবোর্ড। এসব বিলবোর্ডের কারণে ঢাকা পড়ছে এর সৌন্দর্য। ঝিলের মগবাজার ও মধুবাগ অংশে এমনও দেখা গেছে আশপাশের বাসা বাড়ির লোকজন কোন রাস্তাও আর দেখতে পাচ্ছে না। হাতিরঝিল ১ নম্বর পানির পাম্প মোড় এলাকায় বিল বোর্ডের দিকে লক্ষ্য রাখতে গিয়ে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছু অতিলোভী লোক নীচু বাড়ির ছাদে উঁচু ও দীর্ঘ বিলবোর্ড বসিয়ে দিয়েছে। এখন বাসা বাড়িতে বসবাসকারী এবং মধুবাগ মাঠ থেকে উত্তরের অংশ একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। ওই বিলবোর্ডের কারণে ঝিলের দক্ষিণ অংশ একেবারেই ঢেকে গেছে।

এছাড়া লেকের পাশে হাঁটার আলাদা পথ থাকলেও সবুজ ঘাস মাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওভারলুপগুলোর নিচে ফাঁকা স্থানে বসছে হকার। অসচেতন দশনার্থীদের ফেলা ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে লেকের পাশের রাস্তাসহ আশপাশের জায়গা। পরিচর্যার অভাবে মরে যাচ্ছে বিদেশি দামি গাছ। কোন কোন গাছ ইতিমধ্যেই মরে পাতা শুকিয়ে গেছে।
হাতিরঝিল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এভাবে চলতে থাকলে হাতিরঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য ধরে রাখা খুবই কষ্টকর হবে। এজন্য মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি অতি দ্রুত হাতির ঝিল রক্ষণাবেক্ষণ বোর্ড গঠন জরুরি। আর হাতিরঝিলের নানা অব্যবস্থাপনা দেখে দর্শনার্থীরাও হতাশ। তাদের কণ্ঠেও ক্ষোভ। দিন দিন সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও মানুষের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন অনেকে।
সস্ত্রীক হাতিরঝিল পরিদর্শনে এসে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজধানীর মানিকনগরের বাসিন্দা নাজমুল আহসান রাজু বলেন, এক বছর আগের হাতিরঝিল আর এখনকার হাতিরঝিলের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তখন সৌন্দর্য দেখে মন হতো ঢাকার শহর নয় বিদেশের কোন শহরে ঘুরছি আর এখন এখানে এলে একটা অস্বস্তি লাগে। লেকের পানিতে দুর্গন্ধ। লেকের ধারে আবর্জনা দেখে মনে হয় হাতিরঝিলের সৌন্দর্য দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
হাতিরঝিল দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী তেজগাঁও শিল্প এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লুৎফর রহমান কাকন জানান, হাতিরঝিলের আগের সৌন্দর্য আর নেই। দর্শনার্থীরা এর সৌন্দর্য রক্ষার জন্য যেমন সচেতন নয় তেমনি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাও কম দায়ী নয়। চারদিক বিলবোর্ডে ঢেকে গেছে। লেকের পানি আবর্জনায় ভরা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিবেশ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, হাতিরঝিলে সৌন্দর্য রক্ষার দায়িত্ব সকলের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রস্তাবনা আসে এবং ২০০০ সালে শহরাঞ্চলের জলাভূমি রক্ষার আইন পাশ হয়। রাজনৈতিক সরকারগুলো প্রকল্পটির ব্যাপারে কোন গুরুত্ব না দিলেও ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকল্পটির বিষয়ে জোর দাবি উঠতে থাকে। ওই বছরই বিজয় সরণিতে অবৈধ র‌্যাংগস ভবন ভেঙ্গে ফেলা এবং হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এরপর ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট একনেকে ১ হাজার ৪৭৩ কোট ৫৮ লাখ টাকার প্রকল্প ব্যয় অনুমোদন করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর এই ব্যয় ৪৯৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়।
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এলজিইডি ও ঢাকা ওয়াসা। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খালের পানি দূষণমুক্ত করা এবং রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করা। পাশাপাশি রাজধানীবাসীর জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন। ৩০২ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এ প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন।
জানা গেছে, মাত্র ২২ মাসেই একদিকে হাতিরঝিল হারাচ্ছে সৌন্দর্য অন্যদিকে বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়। প্রকল্পটির কাজ কবে শেষ হবে তার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, তার সাথে নেই ব্যয়ের সীমাও। বর্তমানে প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণের পাঁচটি খাতে প্রতিমাসে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে কমবেশি ২৭ লাখ টাকা। বছর শেষে তা গিয়ে দাঁড়ায় পৌনে চার কোটি টাকাতে। কর্তৃপক্ষ এ অবস্থায় প্রকল্পটির কাজ সমাপ্তির পথে থাকবে, না রক্ষণাবেক্ষণের দিকে তাকাবে, তা নিয়েই হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়েছে।
এদিকে হাতিরঝিলে ডাইভারশন পয়ঃনিষ্কাশন কার্যকর করা না গেলে পরিবেশ দূষণ ছড়িয়ে পড়বে বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি অনেক আগেই দেয়া হয়েছিল।
তারা বলেছেন, দাসেরকান্দির ময়লা পানি পরিশোধন প্লান্ট স্থাপন না হওয়ায় হাতিরঝিল প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। তবে দাসেরকান্দি প্লান্টটি ঠিক কবে শুরু হবে, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না কেউ। আফতাবনগরের শেষ প্রান্তে দাসেরকান্দিতে এই প্লান্টটি হওয়ার কথা। বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। জমির দরকার প্রায় ৬০ বিঘা। ঢাকা ওয়াসার ওপর দাসেরকান্দির পরিশোধন প্লান্ট বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, প্লান্টের নকশা ও সমীক্ষা শেষ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও অনুমোদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। অর্থ সংগ্রহেরও জোর চেষ্টা চলছে।
এদিকে প্রকল্প এলাকার কঠিন ও তরল সব ধরনের আবর্জনা পরিষ্কার করা নিয়ে সরকারি তিন সংস্থার মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। রাজউক, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা সিটি করপোরেশন একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
রাজউকের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ঢাকার আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের। আমরা উত্তর সিটি করপোরেশনকে বারবার চিঠি দিচ্ছি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বিপন কুমার সাহা জানান, ‘যারা হাতিরঝিলের মালিক, প্রকল্প এলাকা পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও তাদের। না হলে হাতিরঝিল সিটি করপোরেশনের হস্তান্তর করে দিক, আমরা পরিষ্কার করবো।
হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে রাজউকের একজন সদস্য জানান, হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণ বোর্ড গঠনের জন্য দুটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদন থাকবে কীভাবে হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। এরপর বোর্ড সেভাবে কাজ করবে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জামাল আক্তার ভুঁইয়া জানান, যেহেতু হাতিরঝিল প্রকল্পে শুধু অবকাঠামো কাজের বরাদ্দ এছাড়া অন্য কোনো খাতে টাকা বরাদ্দ নেই। সেহেতু এসব সেবা বাড়িয়ে তা থেকে আয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে যেমন ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি কোষাগারের টাকা লাগবে না, ঠিক তেমনি মানুষের বিনোদনের অনুষঙ্গও বাড়বে। এ বছরের শেষ নাগাদ হাতিরঝিল তার নতুন রূপ পাবে বলে তিনি দাবি করেন
তিনি জানান, হাতিরঝিলকে ঘিরে আরও যে প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে হাতিরঝিলকে হকারমুক্ত করে অস্থায়ী ভিত্তিতে ভালোমানের খাবারের রেস্তোরাঁ বানানোর উদ্যোগ। থাকছে অ্যামফি থিয়েটার। যার মাধ্যমে লেজার শো উপভোগ করতে পারবেন দর্শনার্থীরা। এ সবকিছুই হবে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আওতায়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, হাতিরঝিল নির্মাণের যে পরিকল্পনা তা সঠিক নয়। কারণ এটা পরিবেশবান্ধব না হয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হবে বলে তার বিশ্বাস।
তিনি জানান, গাড়ি চলাচলের পরিবর্তে যদি ‘ওয়াকওয়ে’ করা হতো তাহলে ভালো হতো। এছাড়া নৌপথ হলে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য হতো। তিনি অভিযোগ করেন, হাতিরঝিলের পানি পরিবেশবান্ধব কিনা তা পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করা হলেও তাদের পরীক্ষা করতে দেয়া হয়নি।

 

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone