বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|শনিবার, মে ৪, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিবিধ » ৫১ বছর পর মিলল উধাও হওয়া বিমান ‘স্টারডাস্ট’

৫১ বছর পর মিলল উধাও হওয়া বিমান ‘স্টারডাস্ট’ 

full_838841575_1389352301

অনলাইন ডেস্ক : ১৯৪৭ সালের ২রা অগাস্ট, একটি বৃটিশ সিভিলিয়ান ভার্সন ল্যাঙ্কাস্টার (Lancaster) বোমারু যুদ্ধবিমান আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স এয়ারপোর্ট থেকে সান্টিয়াগোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। স্টারডাস্ট (Stardust) নামক এই প্লেনে ৫ জন ক্রু আর ৬ জন যাত্রী ছিল। কিন্তু স্টারডাস্ট কখনোই আর সান্টিয়াগোতে পৌছায় নি। এর পরিবর্তে এটা বেমালুম গায়েব হয়ে যায় অবতরণ অঞ্চলের মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বেই! শেষবারের মত কেবল একটি রহস্যময় মোর্স কোড “STENDEC” পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু এরপর প্লেনটি থেকে আর কিছুই শোনা যায় নি। (Morse Code, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত একটি সাংকেতিক ভাষা, যেখানে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট বিরতির পরপর একটি শব্দের মাধ্যমে এক একটি ইংরেজি অক্ষর বুঝিয়ে কোন বার্তা পৌছান হতো)

কর্তৃপক্ষ আন্দিজ পর্বতমালায় ব্যাপক উদ্ধার অভিযান চালিয়েও এই প্লেনের হদিস কখনই খুঁজে পায় নি। ৫১ বছর ধরে এই প্লেনের নিখোঁজ ব্যাক্তিদের পরিবার পরিজনেরা জানতেই পারেন নি যে তাদের প্রিয় আপনজনদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল সেদিন!

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। হঠাৎ করেই ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে, প্লেনটি আন্দিজ পর্বতমালার অনেক উঁচু এক স্থানের হিমশৈলে আবির্ভূত হয়, এটি এমন একটি স্থানে যা ছিল প্লেনটির গন্তব্যস্থল সান্টিয়াগো শহর থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে! দু’ জন পর্বতারোহী টুপাংগাটো চূড়ায় আরোহনের সময় প্লেনটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়। সে বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে আর্জেন্টিনার আর্মি অতিকায় টুপাংগাটো চুড়ার (৬,৮০০ মিটার) পাদদেশে এই দুর্ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি বিশাল অভিযানের আয়োজন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেইসব মানব দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা যা ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছে, যাতে করে নিহতদের পরিচয় বের করার একটি উদ্যোগ নেয়া যায়। এই অভিযান, দূর্ঘটনাস্থল তদন্তকারীদের আরেকটি অদ্বিতীয় সুযোগ করে দেয়, হতভাগ্য প্লেনটির ঠিক কি হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করা যায় কি না তা দেখার।

Horizon (বি.বি.সির একটি অনুষ্ঠান) এই অভিযানের বিশেষ প্রবেশাধিকার পায়, আর এখন প্রথমবারের মত ‘স্টারডাস্ট’-এর কি হয়েছিল সেই পরিপূর্ণ গল্প বলা যাবে। প্লেনটি কেন কোনো সতর্ক বাণী না দিয়েই বিধ্বস্ত হলো? কেনই বা এটাকে এর নির্ধারিত পাহাড়ি গন্তব্যস্থল হতে এত দূরে পাওয়া গেল? কী ছিল সেই শেষ রহস্যময় মেসেজ ‘STENDEC’ এর অর্থ যা প্লেনের রেডিও নিয়ন্ত্রকের দ্বারা প্রেরিত হয়েছিল? বিধ্বস্ত হওয়ার ৫০ বছর পরে, অবশিষ্ট দেহাবশেষ সনাক্ত করে কোনো ব্যক্তির পরিচয় বের করা কি সম্ভব যা সাক্ষ্য দেবে সেই ভয়ংকর ধ্বংস্বাত্বক শক্তির যা এই দূর্ঘটনার জন্য দ্বায়ী? এবং সম্ভবত সবচাইতে রহস্যময় প্রশ্ন, বছরের পর বছর ধরে টুপাংগাটো পর্বতে নিয়মিত পর্বতারোহন চলা সত্বেও কেন এই ধ্বংসাবশেষ এত দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যায়নি?

এই অভিযানের সমন্বয় হয়েছিল আন্দিজ পাহাড়ি পাদদেশে। উচ্চতা জনিত অসুস্থতা (altitude sickness) এবং শীতের আগমনের ঝুঁকি বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এই যাত্রার জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন। ৪ দিন ধরে দূর্ঘটনাস্থলে পৌছাবার জন্য ১০০ এরও বেশি খচ্চর আনা হয় মানুষ, প্রয়জনীয় সরঞ্জামাদি ও খাবার দাবার-টানার কাজে ব্যবহার করার জন্য। এরপর হিমশৈলে ঘাটিঁ গাড়ার উদ্দেশ্যে শুরু হয় অভিযাত্রা। ৪৫০০ মিটার দীর্ঘ এই মারাত্মক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বেশ কিছু খচ্চর খাদের কিনারা দিয়ে পড়ে যায়, কয়েকটি ঝুলে যায় দড়ির কারণে।

৪ দিনের অমানুষিক পরিশ্রমের অভিযান শেষে অবশেষে দলটি টুপাংগাটো হিমশৈলে গিয়ে পৌছে। তাদের কাছে তখন ৩৬ ঘন্টা ব্যাপী দুর্ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট রসদ ছিল। ‘হরাইজন’ দূর্ঘটনাস্থলে অভিযাত্রীদের অনুসরণ করল আর তার বিধ্বস্ত হওয়া সম্পর্কে ধারণাগুলি প্রতিটি নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টাতে থাকল। প্লেনটির প্রধান চাকাগুলি আবিষ্কৃত হলো, একটি তখনও সম্পুর্ণভাবে ফোলানো ছিল। স্টারডাস্ট-এর একটি রোলস রয়েস ইঞ্জিন বরফের উপর শায়িত ছিল, আর তার কাছেই ছিল এর প্রোপেলার। প্রোপেলারের ক্ষয়ক্ষতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বিধ্বস্ত হওয়ার সময় প্লেনটির ইঞ্জিন ঠিকঠাকমত কাজ করছিল। ধ্বংসাবশেষে এমন কোন ধোঁয়ার কুন্ডুলির নিশানা ছিল না যা দেখে বোঝা যেতো যে কি কারণে প্লেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়।

মনুষ্য দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল এরপর- একটি হাত, বরফে আচ্ছাদিত দেহের অংশ, চুলের গোছা- এসবই ছিল মানব বিপর্যয়ের এক দুঃখগাঁথা। বুয়েন্স আয়ার্সের একটি ল্যাবে বিজ্ঞানীরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন এইসব দেহাবশেষ হতে যথেষ্ট পরিমাণে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে যাতে করে এ থেকে নিহতদের সনাক্ত করা যায়। প্লেনের সাথে ধ্বংস হওয়া খুব অল্প সংখ্যক মানুষই সন্তান-সন্ততি রেখে যাওয়ার মত প্রাপ্ত বয়ষ্ক ছিল। তাই তাদের ডিএনএ মিলকরণের কাজে বহু দূরের আত্মীয়দের মিল খোঁজা হচ্ছে, যা কাজটাকে আরও জটিল করে তোলে। টুপাংগাটো থেকে প্রাপ্ত দেহাবশেষ শনাক্ত করে ২০০২ সালের ভেতর ৮ জন হতভাগ্য যাত্রীকে শনাক্ত করা হয়।

ইতিমধ্যে, বিমান দুর্ঘটনার তদন্তকারীরা এত বছর ধরে প্লেনটির গায়েব থাকার রহস্য সমাধানে মনোনিবেশ করলেন। তারা তথ্য বিশ্লেষণ করে যা পেলেন তা এই ইশারা করে যে প্লেনটির এতদিন লুকিয়ে থাকার একটি সম্ভব্য কারণ হয়ত এটা যে হিমশৈলের উপর শায়িত ছিল, সেটাতেই নিহিত আছে। তারা পর্বত থেকে ফিরে আসতে না আসতেই, তদন্তকারীরা মেন্ডোজায় (Mendoza) এক হিমশৈল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। তিনি তাদের বললেন যে, যদি প্লেনটি হিমশৈলের উপরের অংশে বিধ্বস্ত হয়, তাহলে এটা বছরের পর বছর তুষারপাতের ফলে ধীরে ধীরে চাপা পড়তে থাকবে, যতদিনে না এটা নিজেই হিমশৈলের একটি অংশ হয়ে না যায়। তারপর হয়তো হিমশৈলের সাথে সাথে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে মাধ্যাকর্ষনের প্রভাবে নিচে চলে গিয়েছিল। যথারীতি এটা একটি উষ্ণতর স্থানে এসে পৌছায়, আর এখানে এসে বরফ গলতে শুরু করে, হাজির হয় স্টারডস্টের অবশিষ্টাংশ। ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি কারণ কারণ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্লেনটি হিমশৈলের নিচে চাপা পড়েছিল।

স্টারডাস্টই একমাত্র প্লেন না যা হিমশৈলের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। গ্রিনল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কার একটি পুরো বিমান বহর ১৯৪২ সালে গ্রিনল্যান্ড বরফ চুড়ায় বিধ্বস্ত হয়েছিল, যা এই কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত হয় বরফের নিচে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে। তারাও তুষারে ঢাকা পড়েছিল যা বছরের পর বছর ধরে আস্তে আস্তে শক্ত হবার পর বরফে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু এত বছর ধরে গায়েব থাকার রহস্য সমাধান হওয়ার পরও আরও কঠিন কাজ বাকি থেকে যায়। কেন প্লেনটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় পথ হারিয়ে যাত্রাপথ থেকে ৫০ মাইল দূরে সরে গিয়েছিল, জানতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর। আর্জেন্টিনীয় অনুসন্ধানের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ছিল যে কেন একজন অতিমাত্রায় অভিজ্ঞ ক্রু এমন একটি মারাত্মক ভুল করলেন। তারা একটি পরিবেশগত ঘটনা তুলে ধরলেন যা ১৯৪৭ সালে দৃশ্যত অজানা ছিল- জেটস্ট্রিম (Jetstream) এই উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় বায়ুপ্রবাহ ঘন্টায় ১০০ মাইল পর্যন্ত বেগে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে খুব অল্পসংখ্যক প্লেন ছিল যা এত উচ্চতায় এই জেটস্ট্রিমের মুখোমুখি হতে পারত। ‘স্টারডাস্ট’ ছিল তেমনই এক ব্যতিক্রম।

উড্ডয়নের ঐ দিনে আন্দিজ পর্বতমালার উপরের বিরুপ আবহাওয়া স্টারডাস্টের ক্রুগণকে বাধ্য করে প্লেনটিকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যেতে, যাতে করে তারা প্লেনটিকে এই আবহাওয়ার উপর থেকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। প্লেনটির সর্বোত্তম পারফর্মেন্সই এর নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উঁচুতে ওড়ার সিদ্ধান্তই প্লেনটিকে সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে যায়। ক্রুদের কারও জানা ছিল না যে তারা জেটস্ট্রীমের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। আর খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা মাটি দেখতে পারছিলেন না, তাই তাদের জানার কোন উপায়ই ছিল না যে জেটস্ট্রিম তাদের নাটকীয়ভাবে ধীর গতির করে দিচ্ছিল। যদিও ক্রুদের হিসেব নিকেশ বলছিল যে তারা আন্দিজ পর্বতমালা পার করে চলে গিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জেটস্ট্রিমের শক্তিশালী বাতাস তাদের তখনও পর্বতের ভুল যায়গায় নিয়ে আটকে রেখেছিল। তাই যখন স্টারডাস্ট অবরোহণ (Descent) বা নিচে নামতে শুরু করে, সান্টিয়াগো এয়ার পোর্টের উপরে থাকার পরিবর্তে এটা টুপাংগাটো পাহাড়ের সাথে সংঘর্ষের অভিমুখে চলে আসে।

অবশেষে, এই জেটস্ট্রিম এত বড় দিক নির্ণয়জনিত ভুল ও তার ফলসরুপ বিধ্বস্ত হওয়ার কারণেরও ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু তদন্তকারীরা শেষ রহস্যের সমাধান করতে ব্যার্থ হন- শেষ বেতার বার্তা- ‘STENDEC’ যা স্টারডাস্ট থেকে প্রেরিত হয়েছিল বিধ্বস্ত হবার ঠিক আগ মুহুর্তে। অনেক ব্যাখ্যাই সামনে দাড় করান হয়েছে কারও কারও মতে সেটি আসলে ছিল DESCENT অর্থাৎ অবতরণ এর সংকেত যা রেডিও অপারেটর ভুলভাবে সাজিয়েছেন, অনেকে আবার বলেছেন সেটা ছিল আসলে কোন অজানা অচেনা UFO-এর সংকেত! কিন্তু এখন পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য কোন ব্যাখাই পাওয়া যায় নি যা সঠিকভাবে বলতে পারে ঠিক কি ছিল সেই বার্তার অর্থ!

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone