বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|বুধবার, মে ৮, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিশেষ সংবাদ » মধ্যস্থতা ও বিচারকের পরামর্শের ভিত্তিতে কমছে মামলাজট

মধ্যস্থতা ও বিচারকের পরামর্শের ভিত্তিতে কমছে মামলাজট 

রোকন উদ্দিনঃ  বাদী-বিবাদীর মধ্যস্থতা ও বিচারকের পরামর্শের ভিত্তিতে কমছে মামলাজট। সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে জুডিশিয়াল স্ট্রেংদেনিং প্রজেক্টের (জাস্ট) আওতায় বিশেষ এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতসহ বেশ কয়েকটি জেলা আদালতে।
একই সঙ্গে অধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্ট সহযোগিতা না পাওয়ায় করা মামলাগুলোও পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হচ্ছে দ্রুততর সময়ে।
সুপ্রিম কোর্টসহ ঢাকা, কিশোরগঞ্জ এবং রাঙ্গামাটি জেলাকে পাইলট জেলা হিসেবে বিবেচনা করে মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচার বিভাগের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে জাস্ট প্রকল্প।
এ ছাড়া রাজশাহী, রংপুর ও কুমিল্লাকে পাইলট জেলা হিসেবে বিবেচনা করে অচিরেই এ সব জেলার আদালতে মামলা নিষ্পত্তি ও কার্যক্রমে গতি বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে দেশের সব জেলাকে এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানা গেছে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, দেশের সব জেলায় মধ্যস্থতা ও পরামর্শের ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তির পদ্ধতি চালু করতে পারলে দ্রুততম সময়ে মামলাজট কমবে। এ পদ্ধতিতে কম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় দ্রুত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যুগ যুগ ধরে রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।adalot
ইউএনডিপির পাশাপাশি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত সময়ে দেশের সব জেলায় মামলা নিষ্পত্তির এ পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্যও আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
জাস্টের দাফতরিক সূত্রানুযায়ী, মধ্যস্থতার আওতায় ২০১৩ সালে পাইলট জেলাগুলোয় মোট ১ হাজার ৩৪০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। শুধু ঢাকা জেলায় নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৫টি মামলা, যার মধ্যে পারিবারিক আদালতের ৭২২টি মামলা রয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় এ সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেশি।
এ পদ্ধতিতে গত বছর ৯ হাজার ৫৬২ জন বিভিন্নভাবে সুবিধা লাভ করেছেন এবং ১৩ হাজার মানুষ মধ্যস্থতার আওতায় কম খরচে পরিত্রাণ পেয়েছেন।
অন্যদিকে একই বছরে এ সব এলাকায় সঠিক পরামর্শ পাওয়ায় নারীবিষয়ক মামলা দায়েরের প্রবণতা কমেছে ২০ শতাংশ। প্রকল্পের অধীনে বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি উপকরণ সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাইলট তিন জেলায় পারিবারিক আদালতের ১৯ জন বিচারক, ২১ জন অতিরিক্ত ও যুগ্ম জেলা জজ এবং ১৪০ জন আইনজীবী এই সুবিধা পেয়েছেন। এ ছাড়া মধ্যস্থতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ৫৫০ জন বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীকে কর্মশালা করানো হয়েছে।
জাস্টের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক বিচারক এস এম কুদ্দুস জামান দ্য রিপোর্টকে জানান, ২০১২ সালের জুলাই মাসে গৃহীত প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়াদ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
তিনি জানান, মধ্যস্থতার আওতায় মামলাজট হ্রাস করার জন্য হাইকোর্টে ৪টি এবং পাইলট তিন জেলায় তিনটি কেস ম্যানেজমেন্ট কমিটি কাজ করছে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে আগেও মামলা নিষ্পত্তি হতো, কিন্তু জাস্টের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়ায় এবং নিয়মিত তদারক করায় নিষ্পত্তির সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে।
কুদ্দুস জামান জানান, বিচার বিভাগকে ডিজিটালাইজড করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অনলাইনে কজ লিস্ট চালু করা হয়েছে। আগামীতে অনলাইনের মাধ্যমে মামলা করার পদ্ধতি চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য সব জেলা আদালতে দুইজন করে জনবল নিয়োগ দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির পদ্ধতি বাংলাদেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় কার্যবিধিতে সংযুক্ত রয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধির আওতায় প্রথমেই বাদী-বিবাদীর মধ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায়। কিন্তু বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের অভাবে খুব একটা সফলতা পায়নি মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির পদ্ধতি। তবে ইউএনডিপির অর্থায়নে জাস্ট প্রকল্পের অধীনে পাইলট জেলাগুলোতে এই পদ্ধতি সফল হয়েছে। এই সফলতা ভবিষ্যতে অন্য আদালতগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি হওয়া এক মামলায় দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের দরিদ্র ঘরের মেয়ে নার্গিসের কোনো মতামত না নিয়েই মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে একই এলাকার রিকশাচালক লাল মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেয় তার পরিবার। বালিকা বয়সের রেশ আর সংসারের দায়দায়িত্ব বোঝার আগেই এক বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় তাদের ছেলে সাফায়েত। ছেলের এক বছর বয়সে তার স্বামী তাকে তালাক দেয়।
কোনো উপায় না পেয়ে নার্গিস মামলা করতে বাধ্য হয়। মামলার খরচ চালাতে নার্গিসকে ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ নিতে হয়। একই কারণে লাল মিয়ার সীমিত সম্পত্তির প্রায় পুরোটা বিক্রি করতে হয়েছে। মামলার প্রতিটি শুনানির দিনে নার্গিস তার স্বল্প উপার্জনের সব টাকা খরচ করে আদালতে হাজির হতো পুনরায় সংসারজীবন শুরু করার আশায়।
পারিবারিক আদালতের বিচারক মুহাম্মদ ইকবাল বাহারের অধীনে নার্গিসের মামলাটির বিচার চলছিল। জাস্টের উদ্যোগে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও ইকবাল বাহারের মধ্যস্থতায় শুনানি হয়। তিন দিনের শুনানিতে দুই মাসেরও কম সময়ে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়। ২০১৩ সালের ২৮ জুলাই প্রায় দুই বছর পর নার্গিস ও লাল মিয়ার পুনরায় বিয়ে হয়।
অন্য একটি দেওয়ানি মামলায় দেখা যায়, রাঙ্গামাটির জেলা আদালতে সিউ হল মঙ মার্মা গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে প্রায় ১০ একর সম্পদের ভাগ চেয়ে একটি মামলা করেন। এই জমি সিউ হল মঙ মার্মা ও তার চাচাতো ভাইয়ের নামে যৌথভাবে রেকর্ড করা ছিল এবং তারা যৌথভাবে জমির দখলে ছিলেন। মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে বাদী-বিবাদী উভয়ই আদালতে আবেদন করেন।
জাস্টের আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেলা যুগ্ম বিচারক মোহাম্মদ ওসমান গনি চতুর্থ শুনানিতে গত ১৫ জুলাই মামলাটি নিষ্পত্তি করেন।
মামলার রায়ে সিউ এক একর জমি এবং প্রায় এক কোটি টাকা পেয়েছেন।
সাধারণভাবে যেখানে একটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করতে বছরের পর বছর এমনকি যুগ পার হয়ে যায়, সেখানে মাত্র চার মাসের মধ্যে এ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone