বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|বুধবার, মে ১, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিশেষ সংবাদ » নানা অনিয়মের অভিযোগ গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে

নানা অনিয়মের অভিযোগ গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে 

রোকন উদ্দিনঃ ভক্তদের দেওয়া অর্থ, দাতাগোষ্ঠীর অনুদান আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে গুরুদুয়ারা পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে। গুরুদুয়ারা শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা মন্দির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত গুরুদুয়ারা নানকশাহীর ‘গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটি বাংলাদেশ’ নামে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের সব শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা মন্দির পরিচালিত হয়।
শিখদের উপাসনালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএল) সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানকশাহী উপাসনালয়। এ ছাড়া ঢাকার বাংলাবাজার, রায়ের বাজার, চকবাজারের উর্দু রোড, নয়া বাজারের ইংলিশ রোড, চট্টগ্রামের ৩৬ জয়নগর ও পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লেন, ময়মনসিংহ এবং সিলেটে

nanok

গুরুদুয়ারা ছিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুদুয়ারা দখলবাজদের কারণে অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে অবস্থিত গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির কার্যালয়। যা ১৮৬০ সালের সোসাইটিস অ্যাক্ট ২১ এর অধীনে বাংলাদেশ সরকারের রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস থেকে ২০০৮ সালের ৮ জুলাই নিবন্ধন লাভ করে। নিবন্ধন নম্বর এস ৮০২০ ৪১/১০৮)।
নিবন্ধনের পর কমিটিতে মোট ৯ জন সদস্য ছিলেন। কাগজ-কলমে ৯ জন থাকলেও বর্তমানে এ কমিটি পরিচালিত হচ্ছে ছয় সদস্যের মাধ্যমে। কমিটির ৬ সদস্যের উপস্থিতিতে ২০০৯ সালের ২৯ মে অনুষ্ঠিত সভায় সুরেশ কুমার (জি সিং) বহিষ্কৃত হন এবং কমিটির বাকি ২ জন সদস্য এখন আর আসেন না।
অনুমোদনপ্রাপ্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন ভারতীয় নাগরিক সুরেশ কুমার (জি সিং)। যিনি বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও বাংলাদেশ আইনে নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ লাভ করেন|
কমিটির নিবন্ধন পাওয়ার বিষয়ে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস এর নিবন্ধক ও অতিরিক্ত সচিব বিজন কুমার বৈশ্য এইদেশ এইসময়কে বলেন, ‘সভাপতির পরিচয় গোপন করেই জি সিং হয়ত কমিটির নিবন্ধন নিয়েছিলেন।’
সুরেশ কুমারকে (জি সিং) বহিষ্কারের পর কমিটির সভাপতি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া।
বহিষ্কৃত সুরেশ কুমার সিংয়ের (জি.সিং) বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২০০৯ সালের ৪ জুন অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের অভিযোগে পরিচালনা কমিটির পক্ষে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
গুরুদুয়ারার নানা অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় উপাসনালয়ের ভক্তদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত বলেন, ‘গুরুদুয়ারা পরিচালনা কমিটিতে নানা অনিয়ম রয়েছে। ভক্তরা গুরুদুয়ারায় যে অনুদান দেন তা আত্মসাৎ করা হয়। ভক্তরা অনুদান দেন সৃষ্টিকর্তার করুণা লাভের জন্য। কমিটিতে অনিয়ম হলে ভক্তদের করার কিছুই নেই।’
গুরুদুয়ারা ঘিরে নানা অভিযোগের বিষয়ে কমিটির বর্তমান সভাপতি সুকোমল বড়ুয়া এইদেশ এইসময়কে বলেন, ‘সুরেশ কুমার (জি সিং) কমিটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৭/৮ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতীয় নাগরিক। হয়ত নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। আমি শুরুতেই কমিটির সদস্য ছিলাম। তবে গভীরভাবে গুরুদুয়ারার নীতিনির্ধারণে সম্পৃক্ত ছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক পরিশ্রম করে গুরুদুয়ারার সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও শিখদের নিয়ে কমিটির কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। গুরুদুয়ারায় একজন হিসাব রক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতি শুক্রবার এখানে সকলকে নিয়ে বসা হয়। আমি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে গুরুদুয়ারার পরিবেশ প্রার্থনার উপযোগী ছিল না। কোনো হিসাব-নিকাশের ধার ধারা হতো না।’
বর্তমান সভাপতি বলেন, ‘আমি ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা রক্ষায় সবার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’
নিজের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তীর ফিরিয়ে দিয়ে সুকোমল বড়ুয়া বলেন, ‘আমি বয়স্ক লোক, দীর্ঘকাল শিক্ষকতাসহ নানাভাবে মানুষের সেবা করে আসছি। আমি নিউইয়র্কের রিলিজিয়ন ফর পিসের মেম্বার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এশিয়ান কনফারেন্স অব রিলিজিয়ন ফর পিসের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে আমার কমিটিতে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। কেউ যদি অভিযোগ তুলে থাকে হয়ত ভুল বুঝে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ সব রটাচ্ছে।’
কমিটির সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ রবি দাস পাপ্পু এই দেশ এই সময়কে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি এখন কিছু বলব না। আমাদের সভাপতির সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে শুনেছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, আপনি গুরুদুয়ারায় আসবেন। গুরুদুয়ারায় আসুন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিচয় গোপন করে সুরেশ কুমার (জি. সিং) এ কমিটির সদস্য এবং সভাপতি হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ করার বিষয়টি সঠিক।’
বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি মনোজ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘নিজের পরিচয় গোপন করে সুরেশ কুমার কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন ওই পদে ছিলেন। তবে রেজিস্ট্রেশনের পর সুরেশ কুমার প্রায় ১০ মাস সভাপতি ছিলেন। তিনি ভারতীয় নাগরিক বিষয়টি জানাজানি হলে ২০০৯ সালের ৪ জুন শাহবাগ থানায় কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জিডি করা হয়। আমি নিজে জিডিতে স্বাক্ষর করি।’
ডায়েরিতে বলা হয়, সুরেশ কুমার (জি. সিং) ভারতের নাগরিক হওয়ার পরও প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয় দিয়ে গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি হন। গুরুদুয়ারা নানকশাহীর উন্নয়ন কাজের ৭৫ লাখ টাকা খরচের হিসাবসহ তার কাছে গচ্ছিত টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে বলা হলেও সুরেশ তা ফেরত দেননি।
জিডি আবেদনে আরও জানানো হয়, জি. সিং নিজের অনিয়ম ধরা পড়ার ভয়ে অফিস থেকে হিসাবের সকল প্রমাণ সরিয়ে ফেলেছেন। এ বিষয়ে তাকে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখলে সুরেশ যে কোনো সময় ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন।
মনোজ কুমার মণ্ডল আরও বলেন, ‘সে সময় সুরেশ কুমারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। বিভিন্ন বিদেশী দাতাগোষ্ঠী ও দিল্লীর স্বর্ণ মন্দিরের সন্তু বাবা সুখা সিংজির কাছ থেকে দান হিসেবে অন্তত দুই কোটি টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন।’
তিনি জানান, ২০০৯ সালের ২৯ মে ৩ নীলক্ষেত রোডের গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির কার্যালয়ে সভা আহ্বান করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক জি সিংকে বহিষ্কার করা হয়।
ওই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সুরেশ কুমার (জি. সিং) এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ২০০৯ সালের ২ জুন জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস বরাবর আবেদন করা হয়। যৌথ মূলধন কোম্পানিজ ফার্মসমূহের পরিদফতর আবেদনপত্রটি গ্রহণ করে।
অভিযোগের পরিণতি কী হয়েছিল জানতে চাইলে নিবন্ধক ও অতিরিক্ত সচিব বিজন কুমার বৈশ্য বলেন, ‘প্রতিদিন বহু অভিযোগ আসে তার সবকিছু বিবেচনায় আনা হয় না। এটি অনেকদিন আগের কথা। বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।’
কমিটির সহ-সভাপতি মনোজ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘সুরেশ কুমার গুরুদুয়ারা ছেড়ে যান। তবে হঠাৎ হঠাৎ তিনি গুরুদুয়ারায় আসেন। তবে তার কোনো ঠিকানা আমাদের জানা নেই। তার আগের যে ফোন নম্বর ছিল সেখানে কল দিয়ে তাকে পাওয়া যায় না।’
তিনি জানান, নারায়ণ রবি দাস পাপ্পু ভালো হিন্দি বলতে পারেন। তাই তাকে এ পদে রাখা হয়েছে।’
এ দিকে কোনোভাবেই সুরেশ কুমার (জি. সিং)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার বাসার একটি ফোন নম্বর (৮৮০-২-৮৬৩১৫৪২) পেয়ে একাধিক দিন কল করলেও তা কেউ রিসিভ করেননি।
গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য পরশ রাম এইদেশ এইসময়কে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে দেখা গেলেও এখন সুরেশ কুমার জি. সিং কোথায় আছে তা আমাদের জানা নেই। তবে শুনেছি, তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুরুদুয়ারার একটি সূত্র জানায়, ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবি নারায়ণ দাস পাপ্পু সুরেশ কুমারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। সম্প্রতি গুরুদুয়ারায় বসে তারা একসঙ্গে চা পান করেছেন।
ওই সূত্রের অভিযোগ- এখনও সুরেশ কুমার জি. সিংয়ের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে পাপ্পু গুরুদুয়ারা পরিচালনা করেন।
গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবিদাস পাপ্পু বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘সুরেশ কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে গুরুদুয়ারায় ভালোমন্দ সব মানুষই আসতে পারে। উপাসনালায়ে কেউ এলে তাকে তো নিষেধ করা যায় না।’

 

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone