বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » পর্যটন » পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক

পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক 

nnnn

ইজাজ ফারুক মেহেদিঃ  পরিবেশ ও উন্নয়ন_এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক বহুকালের পুরনো। দিন দিন অবশ্য এ বিতর্ক কমে আসছে nnnnদেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মান পরিবেশ মন্ত্রণালয় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণসম্পদ ধ্বংস হওয়ায় প্রতিবছর বিশ্বের সব দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ বা দুই লাখ কোটি ইউরো ক্ষতি হচ্ছে। ‘দি ইকোনমিকস অব ইকোসিস্টেম অ্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রটি জার্মানির বনে জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক নবম সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। ২০০৬ সালে স্টার্ন রিভিউ এ সিদ্ধান্তে আসে যে জলবায়ু পরিবর্তনকে অনিয়ন্ত্রিত রেখে দিলে বিশ্ব জিডিপির ২০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। অথচ এর রাশ টেনে ধরতে ব্যয় হবে বিশ্ব জিডিপির এক শতাংশেরও কম। ২০০২ সালের আগস্টে ‘টেকসই উন্নয়ন : জোহানেসবার্গ সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস ডি উলফেনসন উল্লেখ করেন, ‘আমরা যদি সতর্ক না হই, ভবিষ্যতের জন্য উন্নত নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলি এবং উৎপাদন ও ভোগের বর্তমান প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সামাজিক ও পরিবেশগত অবক্ষয় আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জিত হবে না।’
পরিবেশকে গৌণ বিবেচনা করে যারা উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে, তারা উন্নয়ন শব্দটি আগে এবং পরিবেশকে পরে স্থান দেয়; অর্থাৎ বিষয় দুটিকে তারা একত্রে উপস্থাপন করে ‘উন্নয়ন ও পরিবেশ’_এভাবে। অন্যদিকে যারা পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে, তারা পরিবেশ শব্দটিকে ঠাঁই দেয় আগে। ‘উন্নয়ন ও পরিবেশ’_এভাবেই তারা উপস্থাপন করে পুরো বিষয়টিকে। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ ইস্যুটিকে কে কিভাবে বিবেচনা করে তার ভিত্তিতে ভিন্নতা দেখা যায় উন্নয়ন মডেলেও।
মানুষকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে গণ্য না করে বরং তাকে প্রকৃতির ওপর সর্বময় প্রভু হিসেবে গণ্য করার মনোবৃত্তিই প্রচলিত উন্নয়ন মডেলের মূল ভিত্তি। প্রচলিত এ উন্নয়ন মডেলটি গড়ে উঠেছে পণ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। জীবনের অন্য সব দিককে উপেক্ষা করে কেবল বস্তুগত দিককে প্রাধান্য দেওয়া হয় এতে। এ কারণে এ মডেল অনুযায়ী কোনো দেশের উন্নয়ন ও জনগণের সমৃদ্ধির মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয় ওই দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (উেচ), মোট জাতীয় উৎপাদন (ঘেচ) ও মাথাপিছু আয়কে (চবৎ ঈধঢ়রঃধ ওহপড়সব)। মাদকদ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি এবং অশ্লীল সাহিত্য বা চলচ্চিত্র নির্মাণও জিএনপির অন্তর্ভুক্ত। এসবের উৎপাদন সমাজ বা মানুষের কতটা উপকারে আসে না আসে তা বিবেচনা করা হয় না মোটেই। প্রচলিত এ উন্নয়ন ধারায় মুনাফাই আসল। এ উন্নয়ন ধারা গড়ে উঠেছে যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে, সেটি হলো নিমিত্তবাদ।
একসময় এ ধারণা প্রচলিত ছিল যে প্রকৃতি বা পরিবেশই মানুষের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। বহুকাল ধরে চলে এসেছে এ ধারণা। ইউরোপে নবজাগরণের সময় এ ধারণা বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী দাস রাতসেল দার গজেলশাফট এ ধারণার প্রধান হয়ে ওঠেন। তাঁকে সমর্থন করেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী মোস্পল। নিজের লেখায় মোস্পল উল্লেখ করেন, মানুষ ভূপৃষ্ঠের সন্তান, তার ধুলোর অংশ, যে ধুলো তার হাড়-মাংস-মানসিকতা ও হৃদয়ের মধ্যে মিশে আছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রতিষ্ঠাতা এইচ জে ম্যাকিন্ডারও এমনটিই মনে করতেন। এ ধারণার ভিত্তিতেই শেষ পর্যন্ত হিটলারের মন্ত্রণাদাতা কার্ল হশোফার (১৮৬৯-১৯৪৬) নিমিত্তবাদের তত্ত্ব দাঁড় করান। এতে বলা হয়, ঈশ্বর জার্মান জাতকে তৈরি করেছেন নিখাদ আর্য রক্ত দিয়ে আর জার্মানির অবস্থান স্থির করেছেন এমনভাবে, যাতে গোটা বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে দেশটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের ফলে এ তত্ত্বের গুরুত্ব অনেক কমে যায়। তত দিনে পশ্চিম ইউরোপে আরেকটি তত্ত্ব দানা বেঁধে উঠছিল, যাকে বলা হয় সম্ভাবনাবাদ। এতে মানুষের কর্মকাণ্ডের নিয়ামক শক্তি হিসেবে প্রকৃতিকে বর্ণনা না করে, বরং মানুষকেই মুখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, পরিবেশ মানুষের ব্যবহারের জন্য যে ভাণ্ডার সাজিয়ে রেখেছে, সেই ভাণ্ডার মানুষ তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে, যেমনটি অন্য কোনো জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এটিও এক ধরনের নিমিত্তবাদ, যাতে প্রকৃতির বদলে মানুষকে সর্বশক্তিধর বলে মনে করা হয়। আসলে এ তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের প্রাকৃতিক শক্তির ওপর পুঁজিবাদের অবাধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দর্শন হিসেবে কাজ করেছে।
আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আজ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যান্ত্রিক শিল্পায়নের চেষ্টা যতভাবে করা হয়েছে, সে তুলনায় খুব সামান্য চেষ্টাই চালানো হয়েছে পরিবেশসম্মত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। ফলে গোটা বিশ্বের পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের মুখে। এ প্রেক্ষাপটেই উন্নয়নের বিকল্প হিসেবে ‘টেকসই উন্নয়ন’ শব্দযুগল বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এ শব্দযুগল সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায় ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডবি্লউসিইডি) প্রকাশিত এক রিপোর্টের মাধ্যমে। এ কমিশন সাধারণভাবে ব্রডল্যান্ড কমিশন নামে পরিচিত। এ ছাড়া ২০০২ সালে জোহানেসবার্গে জাতিসংঘ আয়োজিত এক সম্মেলনের মূল এজেন্ডাই ছিল টেকসই উন্নয়ন। ব্রডল্যান্ড কমিশনের প্রকাশ করা রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘আওয়ার কমন ফিউচার’। রিপোর্টে টেকসই উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে_এটা এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সম্পদ আহরণ, বিনিয়োগ নির্দেশনা, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিভাজন এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনগুলো শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
ভারতের বিশিষ্ট উন্নয়ন গবেষক কমলা ভাসিন টেকসই উন্নয়নকে চিত্রিত করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন হিসেবে, যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো জনমুখিনতা, জেন্ডার সংবেদনশীলতা, তৃণমূল গণতন্ত্র ইত্যাদি। এক প্রবন্ধে কমলা ভাসিন প্রচলিত উন্নয়ন মডেলকে চিহ্নিত করেছেন চাপিয়ে দেওয়া কর্তৃত্বশীল মডেল হিসেবে। তাঁর মতে, এ উন্নয়ন মডেলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ বৈরিতা, জেন্ডার অসচেতনতা, সামরিকীকরণ ও সমরসজ্জামুখিনতা, একরূপতা, বৈচিত্র্য হ্রাস ইত্যাদি।
সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের মতে, টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে চাইলে মানবজাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষা এবং যে ইকোসিস্টেমের ওপর সবার প্রাণ নির্ভরশীল তাকে রক্ষার জন্য গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে আমাদের।
পরিবেশ ও উন্নয়নসংক্রান্ত আধুনিক চিন্তাধারায় তাই বিষয় দুটির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য আন্তসম্পর্কের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। কোনো উন্নয়ন কাজ হাতে নেওয়ার আগে ভেবে দেখা হয় যে, ওই উন্নয়ন সম্পন্ন করতে গেলে তার মাধ্যমে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে কি না। কেননা সাময়িক উন্নয়নের জন্য পরিবেশ নষ্ট করা হলে জনজীবন ও অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone