বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|সোমবার, মে ৬, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক বছর থামেনি স্বজজনদের আহাজারি

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক বছর থামেনি স্বজজনদের আহাজারি 

full_1556778761_1398290478

প্রধান প্রতিবেদক : রানা প্লাজার ধস বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্প দুর্ঘটনা। অতিলোভী সর্বগ্রাসী মালিকপক্ষের স্বার্থের কোপানলে হতাহত হয়েছে কত প্রাণ তার অনুপুঙ্খ হিসাব কোনোদিন কেউ দিতে পারবে না। নিরন্তর শ্রমে দরিদ্র বাংলাদেশকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর সংগ্রামে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবন ও সম্মান কত তুচ্ছ তার নগ্নরূপ দেখছে বিশ্ব।

আজ এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার এক বছরপূর্তি হলেও এখনও থামেনি স্বজন হারাদের আর্তনাদ। এছাড়া এই হতভাগা স্বজনদের দিকে এখন আর তাকাচ্ছেনা কেউ।

গত বছর এই দিনে সর্বনাশ হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রাবিয়া বেগমের। রানা প্লাজা ধসে নিখোঁজ হলো মেয়ে রেহেনা পারভীন। আজও সন্ধান মেলেনি তাঁর। মেয়ের ছবি হাতে সন্তানহারা এই মায়ের বুকফাটা নিষ্করুণ আহাজারিতে গতকাল ভারী হয়েছিল বাতাস।

রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় স্বামী আবদুল করিমকে হারিয়েছেন সোনাবানু।  স্বামীর কথা জানতে চাইলেই তিনি দৃশ্যের অবতারণা শুরু করেন। তিনি জানান, এক বছর আগে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় গার্মেন্টকর্মী স্বামী আবদুল করিমকে হারান তিনি। এরপর দিন মাস বছর পেরিয়ে গেলেও খোজ মেলেনি স্বামীর মৃতদেহের। ডিএনএ পরীক্ষায় না মেলায় সরকারের পক্ষ থেকে পাননি কোনো সহায়তা। এমনকি বিজিএমইএ’র কাছ থেকেও মেলেনি কোনো ধরনের সহায়তা।

বাবা-মাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। এখন স্বামীকে হারিয়ে এক প্রকার মানবেতর জীবন যাপন করছেন সোনাবানু। ছোট দুটি সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে তার ‍দু’চোখে ঘোর অন্ধকার। কোথায় যাবেন? কি করবেন? কিছুই ঠিক করতে পারছেন না। শ্বশুর শাশুড়ি থাকলেও তারা কোনো খোঁজ নেন না।

শুধু রাবিয়া বেগম আর সোনাবানুর স্বামী আবদুল করিম না, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় জীবন হারানো ২৯১ জনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের মতোই দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন অনেকের স্বজনেরা। কিন্তু বছর ফুরালেও ফুরায়নি তাদের চোখের জল।

নিহতের সংখ্যাঃ
রানা প্লাজা ধসের ক্ষণ বছর ঘুরলেও নিহত ও নিখোঁজদের সঠিক সংখ্যা বের করতে পারেনি সরকার। ফলে সরকারের পরবর্তী সব পদক্ষেপই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব হিসাব পাওয়া গেছে তাতে অসংগতির যেন শেষ নেই। এসব বিভ্রান্তি নিরসনেরও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু নিরসনের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।

জেলা প্রশাসক অফিসে রক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। এ নিয়ে বর্তমানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে।

৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। অসনাক্তকৃত মরদেহের মধ্যে পুরুষ ৫৫ এবং নারী ২৩৬ জন।

এছাড়া ১ হাজার পাঁচশ ২৪ জন আহত হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এমন আহতের সংখ্যা ৭৮ জন। তবে হতাহতের সঠিক কোনো সংখ্যা না থাকার কারণে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বা সহায়তার কাজটিও কতটা নির্ভুলভাবে করা যাবে তা নিয়েও রয়েছে জটিলতা।

ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা:
সরকার তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের লাশ দাফনের জন্য প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে ৮৪৪ জনকে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রদান করে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার জন্যও ৫ হাজার টাকা করে দেয় সরকার।

দুর্ঘটনার পর দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেও ‘রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি তহবিলে মাত্র ১৭ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে। অথচ দুর্ঘটনার পর পাওয়া প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তির মাত্র একদিন আগে মাত্র দুজনকে ওই ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়ার কাজ শুরু করেছে এই সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি।

কবে নাগাদ পুরোদমে এই কাজ শুরু করা হবে এবং শ্রমিকদেরকে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে কি না সে কথা অবশ্য জানা যায়নি। তবে বিবিসির কাছে কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ) মাধ্যমে সবার কাছে এই অর্থ পৌঁছে দেয়া হবে। তবে অনুদান প্রদানের এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অর্থ পৌঁছানোর বিষয়টি অধিকাংশ শ্রমিকই জানে না।

গত ১৭ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত ৫৩ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার চেক হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার তেজগাঁও কার্যালয়ে ৫৩ পরিবারের ৭৩ সদস্যের হাতে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেন। গত বছরের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী তার ত্রাণ তহবিল থেকে নিহতদের পরিবার ও আহতদের মাঝে এ পর্যন্ত মোট ২২ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা বিতরণ করেছেন।

এদিকে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্ট স্বঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। ওই রুলের শুনানিতে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি আদালতে বলেছিলেন, ‘ভবন মালিক ও গার্মেন্ট মালিকদের কাছ থেকে ৬শ কোটি টাকা আদায় করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে। যার মধ্যে ভবন মালিক দেবে তিনশ কোটি টাকা ও গামের্ন্ট মালিকরা দেবে বাকি তিনশ কোটি টাকা।’

সমন্বিত উদ্যোগঃ
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে বড় বড় শিরোনামের পর ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পোশাক খাতের জন্য সরকার, উদ্যোক্তা, বিদেশি ক্রেতা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও শ্রমিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, আইনকানুন ও নানা ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার এবং আইনের প্রয়োগ।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান একে দেখছেন ঘুরে দাঁড়ানোর নজির হিসেবে।

তিনি বলেন, “অতীতে এতো বড় দুর্ঘটনাও ঘটেনি, এতো বড় উদ্যোগেরও প্রয়োজন পড়েনি। এই যে সমন্বিত একটা কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে দুর্ঘটনার বাস্তবতাটাকে বিবেচনায় রেখে, এটাকে এক কথায় আমি বলবো অভূতপূর্ব।”

রানা প্লাজার ঘটনার পরই অগ্নিনির্বাপনের ওপর সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ অ্যাকশন প্ল্যান এবং সরকারের গঠিত বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

কারখানার কমপ্লায়েন্স ইস্যুটি যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মানছেন বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ।

তিনি বলেন, “কমপ্লায়েন্স ইস্যু বলতে আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এবং এই পরিবেশ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মপরিবেশ ও নজরদারিতে উন্নতিঃ
এ ঘটনার পর কারখানা পরিদর্শন অফিসের ব্যাপক সংস্থার করে এর লোকবল কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে, ২৩টি পরিদর্শক টিম গঠন করে ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে।

এছাড়া নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে অগ্নিনির্বাপন খাতে, শ্রমিক কল্যাণেও নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। একই ভবনে বিভিন্ন ধরনের কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই ভবনের কারখানা থেকে (শেয়ার্ড বিল্ডিং) ভবিষ্যতে পোশাক কেনার বিষয়ে ক্রেতাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

এটা মাথায় রেখেই দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের জন্য ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জে সরকার একটি পোশাক শিল্প পল্লী গড়ে তোলারও উদ্যোগ নিয়েছে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone