বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » রোগীরা চিকিৎসা ব্যয়ের ভারে বিপর্যস্ত

রোগীরা চিকিৎসা ব্যয়ের ভারে বিপর্যস্ত 

প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে ৯০ শতাংশ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব,  বলছেন চিকিৎসকেরা।

রোকসানা (৩১) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। চোখেমুখে অসুস্থতার ছাপ তীব্র। এই প্রতিবেদক কথা বলার জন্য পাশে বসলে জানালেন, তিন মাস আগে তাঁর ডান স্তনে ক্যানসার ও গর্ভাশয়ে টিউমার শনাক্ত হয়।

আজ বিশ্ব স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস

স্তন ক্যানসারের ধাপসমূহ। ছবি: অনলাইন ডেক্স

আজ ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস, অপ্রতুল সেবাব্যবস্থা আর ব্যয়বহুল চিকিৎসার এই চিত্রের মধ্যে।

আক্রান্তের দিক দিয়ে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের অবস্থান তৃতীয়, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) সর্বশেষ ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে। স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয় প্রতিবছর বাংলাদেশে নতুন করে আনুমানিক ১৩ হাজার ২৮ জনের। নতুন ও পুরোনো রোগী মিলিয়ে বছরে মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন।

 

রোগীকে ক্যানসারজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্যানসারের উপসর্গ দেখা না দিলে। বাংলাদেশে বছরে স্তন ক্যানসারজয়ী ঘোষিত হন ৩১ হাজার ২৩২ জন।

বিকল যন্ত্র

হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ রোগীকে ক্যানসার চিকিৎসার কোনো না কোনো সেবা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিতে হয়েছে, পর্যাপ্ত যন্ত্র না থাকা ও রেডিওথেরাপি যন্ত্র বিকল থাকায়। জমি বিক্রি করে, পরিবারের সদস্য বা বাইরের লোকজনের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা ব্যয় চালাতে হচ্ছে তাঁদের। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যানসার চিকিৎসার ৫০–৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়।

অথচ গত এক বছর ধরে নষ্ট ছিল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের পাঁচটি।  ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চালানো হয়েছে ১০ বছর মেয়াদের যন্ত্র। গত সপ্তাহে একটি যন্ত্র মেরামত করে চালু করা হয়েছে। ফলে কম খরচে রেডিওথেরাপি দিতে আসা রোগীরা সিরিয়াল না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক তাঁর কার্যালয়ে বলেন, অত্যাধুনিক দুটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র কেনা হয়েছে ৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে। এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ যন্ত্র এসে পৌঁছাবে। আগামী বছর আরও দুটি যন্ত্র কেনা হবে। তিনি জানান, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ রোগী আসেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ স্তন ক্যানসারের রোগী।

বছরে গড়ে ছয় লাখ টাকার বেশি ব্যয়

ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে ‘বাংলাদেশে ক্যানসার সেবায় অর্থায়ন: বিকল্প পথ’ শিরোনামের একটি গবেষণা ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সেস–এ প্রকাশিত হয়। ২৬২ জন ক্যানসার রোগীর ওপর গবেষণা করা হয়, যার মধ্যে স্তন ক্যানসারের রোগী ছিলেন ৩০ জন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কাঠামোগত কোনো অর্থনৈতিক পদ্ধতি না থাকায়।

ক্যানসার রোগের চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার, থেরাপি, বিভিন্ন পরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফি, ওষুধ, ইনজেকশন, যাতায়াত, হাসপাতালে থাকা, রোগীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তির জন্য খরচ বাবদ দেশে বছরে একজন ক্যানসার রোগীর খরচ হয় ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৫ টাকা। রোগীর ২ লাখ টাকা খরচ হয়, অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি তিনটিই সরকারি হাসপাতালে নিলে। কোনো একটি চিকিৎসা বা সবটুকু চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালে নিলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।

ওই গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, গবেষণাটি যখন হয়েছিল, তখনকার চেয়ে এখন ব্যয় আরও বেড়েছে। তাই সরকারি হাসপাতালে বেশি সংখ্যক রোগীর সেবাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আটটি বিভাগে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করছে সরকার। সেসব হাসপাতালে যথাযথ সেবা দিতে এখন থেকেই দক্ষ ক্যানসার চিকিৎসক ও জনবল প্রস্তুত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে।

চিকিৎসা নিতে সচেতন হতে হবে শুরুতে

 অক্টোবর মাসকে স্তন ক্যানসারে সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়, গোলাপি রংকে থিম ধরে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, মানুষকে সচেতন করার বিভিন্ন বার্তা লেখা এবং জায়গায় জায়গায় গোলাপি বেলুন দিয়ে সাজানো। বিনা মূল্যের স্ক্রিনিং (পরীক্ষা) কর্মসূচি চলছে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৪৫ জন নারী স্ক্রিনিং করেছেন।

হাসপাতালের গাইনি ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাহানা পারভীন বলেন, স্তন নিজে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের আরও সচেতন হতে হবে। অবস্থা খারাপ হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে আসেন বেশির ভাগ নারী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানকে বুকের দুধ পান না করালে, পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণ করলে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, অতিরিক্ত ওজন থাকলে, ধূমপান ও তামাকের ব্যবহারে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। স্তনে চাকা, স্তনের বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, স্তনের বোঁটা দিয়ে রক্ত ঝরা স্তন ক্যানসারের লক্ষণ।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে ও সময়মতো পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারলে ৯০ শতাংশ রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব।

তবে সংকোচের কারণে নারীরা স্ক্রিনিংয়ে পিছিয়ে থাকেন। ফলে তিন-চতুর্থাংশ রোগ ধরা পড়ে রোগের শেষ পর্যায়ে। স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার—এই তিনটির জন্য সমন্বিত জাতীয় স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone