দালাল চক্রে জিম্মি পাসপোর্ট অফিস
প্রধান প্রতিবেদক : বিশেষ চক্রের তালুবন্দি হয়ে পড়েছে রাজধানীর আগারগাঁও এ অবস্থিত বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসটি। আনছার সদস্য, অফিসকর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ চক্র। যার কারণে নিয়ম মানতে গিয়ে জুতার তলা ক্ষয় করেও মিলছে না পাসপোর্ট নামক সোনার হরিণ। কিন্তু ওই চক্রের সঙ্গে চুক্তিতে গেলে পানির মতো সহজ হয়ে যাচ্ছে অসাধ্য(?) কাজটি।
সরজমিনে ঘুরে বেশক’জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এমন চিত্র।
দেখা যায়, বিশেষ এ চক্রের সদস্যরা সার্বক্ষণিক পাসপোর্ট অফিসের প্রধান গেটের সামনে ও আশপাশে ঘোরাফেরা করে। যখনই কেউ পার্সপোর্ট করাতে আসেন তখনই কাছে গিয়ে বলে, ‘লেখাবেন নাকি? ৭ দিনের বিশেষ পার্সপোর্ট ৪ দিনে। আর ১৫ দিনের সাধারণ পাসপোর্ট ৭ দিনে।’ তবে এর জন্য অবশ্য গুনতে হবে বাড়তি খরচ। বিশেষ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে গুনতে হবে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আর সাধারণ পাসপোর্টের জন্য গুনতে হবে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। যেখানে সাধারণ পাসপোর্ট (এক মাস) করতে খরচ ৩ হাজার আর জরুরি পাসপোর্ট (১৫ দিন) করতে খরচ হয় ৬ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, এই টাকার ভাগ যায় প্রশাসন থেকে শুরু করে পাসপোর্ট অফিসের পিয়ন, আনসার এমনকি কর্তাব্যক্তিদের কাছে পর্যন্ত। পাসপোর্টের খরচ ছাড়া অতিরিক্ত যে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা নেয়া হয় তার থেকে থানার তদন্ত কর্মকর্তার বরাবর যায় ৫০০ টাকা, অফিস পিয়ন জাকিরের কাছে যায় ২০০ টাকা, আনসারদের দেয়া লাগে কাজ প্রতি ১০০ টাকা, সত্যায়িত করাতে লাগে ১০০ টাকা। আর সবচেয়ে বড় ভাগটি যায় পাসপোর্ট অফিসের এক কর্তাব্যক্তির কাছে। অনেক চেষ্টা করেও জানা যায়নি সেই কর্তাব্যক্তির পরিচয়।
এদিকে এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হতে পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করতেই খুলতে শুরু করে রহস্যের জট। সহকারী পরিচালক উম্মে কুলসুমের ২০১ নম্বর কক্ষের সামনে দাঁড়ানো আনসার সদস্য মেহেদি হাসান পাসপোর্ট প্রার্থীদের কাগজ নিচ্ছেন। সাথে হাতের মুঠিতে টাকাও নিচ্ছেন। বিনিময়ে সব নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কক্ষের ভেতর থেকে অনুমোদন করিয়ে আনা হচ্ছে পাসপোর্ট। সহকারী পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে যেতে চাইলেই বাদ সাধেন মেহেদি হাসান নামের ওই আনসার সদস্য। জানতে চান, ‘কেন যাব এবং কী কথা বলবো।’
সংবাদ সংগ্রহের কাজে যাব বলতেই তার চোখ ছানাবড়া। সাথে সাথে বললেন, ‘ম্যাডামের সাথে এখন দেখা করা যাবে না। উনি কোনো সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন না। তাছাড়া এখানে সাংবাদিক আসাও নিষেধ।’
পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায় কথা হয় জহির হোসেন নামের এক ব্যক্তির সাথে। তিনি এসেছেন কুমিল্লা থেকে। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে যেতে চান ভারত। তাই প্রয়োজন পাসপোর্ট। ফরমপূরণ থেকে শুরু করে সব কাজই প্রায় শেষ। কিন্তু এখনো দেয়া হয়নি বিশেষ চক্রের কমিশন। তাই আর চূড়ান্ত অনুমোদনও পাচ্ছেন না তিনি।
জহির হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনদিন ধরে তিনি এখানে ঘুরছেন। এক এক বার এক এক কথা বলে তাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রতিদিনই তার পাসপোর্টের নতুন নতুন ভুল ধরে তা ফেরত দেয়া হচ্ছে। এদিন ধরা হয়েছে সত্যায়িত করার ভুল।
জহির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন তারা বলছে আবার নতুন করে সব কিছু করতে হবে। এটাকি কোনো কথা! আমার রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আর আমার পক্ষে এখন দালালদের জন্য কিছুই করা সম্ভব না।’
জহিরের কথা শুনতে শুনতেই হাজির আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি জহিরের সমস্যা শুনে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আরে ভাই, পাসপোর্ট অফিসে এখন টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আমারও এই সমস্যা হয়েছিল। পরে পিয়ন জাকিরের সাথে চুক্তি করে পাসপোর্ট বের করে এনেছি।’
আব্দুর রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা দু’দিন ঘুরেও তিনি পাসপোর্টের ডেলিভারি পাননি। শেষমেষ অফিস পিয়ন জাকিরের সঙ্গে চুক্তি করে ৫ মিনিটেই পেয়ে গেছেন পাসপোর্ট। তার সঙ্গে কথা বলতে না বলতেই ঝড়ের বেগে চলে এলেন জাকির। ‘কী সমস্যা কী সমস্যা’ বলে হাঁটতে থাকেন। তার পিছে পিছে জহির ও আব্দুর রশিদ। সমস্যার কথা শুনে জাকির তাদের তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। মিনিট দশেক পরে জহির ওপর থেকে বেশ হাসি খুশি চেহারা নিয়ে নেমে এলেন নিচে। আর জানালেন, ৫’শ টাকা দিতেই সব ঠিক হয়ে গেল!
পাসপোর্ট অফিসের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখা যায়, ‘মিলি ডিজিটাল স্টুডিও’ মানের একটি ফটোকপি ও প্রিন্টের দোকানের পেছনে আট দশ জন লোকের জটলা। স্থানীয় এক ডাব বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত এরাই ওই সিন্ডিকেটের লোক। তারা সার্বক্ষণিক এখানে বসে থাকে। আর তাদের দালালেরা পাসপোর্ট প্রার্থীদের এখানে ধরে এনে ফরম পূরণ করায়। বিনিময়ে নেয়া হয় কমিশন।
পাসপোর্ট করতে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই দালালদের হাতঘুরে না এলে সেই পাসপোর্ট ছয় মাসেও পাওয়া যায় না। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট না হওয়ার কারণ অনুষন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের গেটে দাঁড়ানো দালালরা প্রথমে পাসপোর্ট প্রার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের লোভনীয় প্রস্তাব দেন। এতে সাড়া না দিলে ওই ব্যক্তিতে আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দেয়া হয়, যাতে কোনোভাবেই তিনি আর পাসপোর্ট করতে না পারে। এসব ভোগান্তি এড়াতে বাধ্য হয়েই অনেকে ধরা দেন দালাল চক্রের কাছে।