বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিশেষ সংবাদ » সক্রিয় শিশু চোর চক্র

সক্রিয় শিশু চোর চক্র 

প্রধান প্রতিবেদকঃ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে প্রায়ই বাচ্চা চুরির মতো ঘটনা ঘটে। বরাবরই অভিযোগ উঠে হাসপাতালের কর্মীদের যোগসাজশের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্প্রতি বাচ্চা চুরির এক সপ্তাহের মধ্যে উদ্ধারের পর এই অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। শিশুটিকে গাজীপুর থেকে উদ্ধারের পর জানা যায়, হাসাপাতালের এক আয়াই সেই শিশুটিকে বিক্রি করেছে ৪০ হাজার টাকায়।
শিশুটিকে চুরির ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে সারা দেশেই। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন হাসপাতালের পরিচালক। স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সে তদন্তে সহযোগিতা করতে এবং শিশুটির পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। আর এই নির্দেশের পরদিন গাজীপুর থেকে উদ্ধারও হয়েছে শিশুটি।

baby

ছবি (মোঃ জাফর ইকবাল)

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল যেখানে নিরাপত্তার আয়োজন থাকে ২৪ ঘণ্টা, যেখানে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে সবার কার্যক্রম তদারকি হয় সর্বদা, সেখানে বাচ্চা জন্ম দিতে এসে এভাবে ভুগবেন কোনো বাবা-মা সেটা মেনে নেওয়া কতটা সম্ভব?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি হয়েছে এর আগেও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দু-একটি শিশু উদ্ধার হলেও কেঁদেই চলছেন বাকিদের বাবা-মা। আবার শিশু উদ্ধার হলেও এই চুরির সঙ্গে জড়িতরা ধরা পড়েনি কখনো। চিহ্নিত হলেও পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বরাবরই অভিযোগ উঠে যে, হাসপাতালের কর্মীরাই জড়িত এই ঘটনায়।
বাংলাদেশে দত্তক নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শিশু চুরির মতো এই ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সন্তান হয় না এমন দম্পতি নানা সময় দত্তক নিতে এতিমখানা বা ‘শিশুদের জন্য করা’ নানা প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। দালালরা নানা সময় তাদের শিশু দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করে আর এক মায়ের কোল খালি করে অন্য জনের মাতৃত্বের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একজনের সন্তান কেড়ে নিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করার মতো ঘটনা ন্যক্কারজনক। এটা গুরুতর অপরাধ। এই ঘটনা এর আগেও দেশে ঘটেছে। তদন্ত করে পুরো চক্রকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
সন্তানহীন দম্পতির মানবিক দিক বিবেচনা করে সন্তান দত্তক নেওয়ার আইন করার বিষয়টি ভেবে দেখতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছেন এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এতে কেবল কিছু মানুষ পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের স্বাদ পাবে না, বিপদগ্রস্ত শিশুদেরও একটি উপায় হবে। যেমন রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর মা-বাবা হারিয়ে অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেছে। এর আগেও নানা দুর্ঘটনায় অভিভাবক হারিয়েছে অনেক শিশু। তাদের কেউ যদি সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, তাহলে তার আইনি বাধা থাকা উচিত নয়।’
২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি নবজাতক চুরির অভিযোগে হাতেনাতে আটক হন এক নারী। তার নাম খাদিজা। এর চেয়ে বেশি পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। গাইনি ওয়ার্ড থেকে কৌশলে বাচ্চাটি চুরি করা হয়। পরে ওই নারীকে আটক করে নবজাতকের মাকে খবর দেয় পুলিশ। তাদের দুজনকে মুখোমুখি করে নবজাতকের মা মুক্তা আক্তারকে বাচ্চাটি ফেরত দেওয়া হয়। নিরাপত্তা কর্মীরা খাদিজাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কর্তব্যরত পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।
জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু উভয় পক্ষের সমঝোতা হওয়ায় মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।’ এরপর আটক খাদিজা মুক্তি পান বলে জানায় পুলিশ।
দুই সন্তান জন্ম দিয়ে একটিকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন রুনা
যমজ সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন রুনা আক্তার। ২১ আগস্ট ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২১৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডের ৬ নম্বর শয্যায় দুইজনকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখেন একটি ছেলে নেই কোথাও। আকাশ ভেঙে পড়ে রুনার মাথায়।
রুনার মা গুলে নূর বেগম জানান, মোহাম্মদপুরের বিজলী মহল্লায় থাকেন তারা। নিরাপদ প্রসবের জন্য তার সন্তান সম্ভবা মেয়েকে নিয়ে বুধবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছেন। পরদিন ভোরে রুনার দুটি সন্তান হওয়ার কথা শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলেন মা গুলে নূর। তার চেয়ে রুনার আনন্দ ছিল আকাশছোঁয়া।

গুলে নূর জানান, হাসপাতালে ভর্তির পর এক অপরিচিত নারী কথা বলেন তাদের সঙ্গে। তার এক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি আছে জানিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন ওই নারী। বৃহস্পতিবার সকালে দুই বাচ্চা একসঙ্গে কান্নাকাটি করলে গুলে নূর বেগম একজনকে কোলে নেন এবং ওই নারী আরেক বাচ্চাকে কোলে নেন। বাচ্চার কান্না থামানোর কথা বলে তিনি ওয়ার্ড থেকে বের হন। তার পর থেকে ওই নারীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিন সদস্যের কমিটি গঠন

ঘটনা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গাইনি ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক আফরোজা কুতুবিকে প্রধান করে পরদিন গঠন করা হয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি।
হাসপাতালের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান পরদিন গণমাধ্যমকে বলেন, শিশু চুরির এই ঘটনাটি দুঃখজনক। এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না তারা। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
সন্দেহ হাসপাতাল কর্মীদের বিরুদ্ধেই
হাসপাতালটি থেকে এর আগেও নানা সময় শিশু চুরির পর ওখানকার কর্মীদের বিরুদ্ধেই উঠে অভিযোগ। তাদের সহায়তায়ই দালাল চক্র হাসপাতালে ঢুকে এই কাজ করে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগীরা। এবারের ঘটনাটিও ইঙ্গিত দিচ্ছে একই যোগসাজশের।
হাসপাতালটিতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থাকলেও শিশু চুরির সময় ওই ওয়ার্ডের ক্যামেরাটি বন্ধ ছিল। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, রাতে শিশু দুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সিসি ক্যামেরা সচল ছিল। কিন্তু ভোরে শিশু চুরির সময় তা কোনো কাজ করেনি। এতে কোনো স্বাভাবিক ঘটনা মানতে নারাজ হাসপাতালেরই একাধিক কর্মকর্তা। তাদের অভিমত, পুরো ঘটনাটিই ঘটেছে পরিকল্পনা করে। এ জন্য শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরা বন্ধ করা হয়েছে। ক্যামেরা পরিচালন করে যারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের দাবিও করেছেন একজন কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শিশু দুটির জন্মের পর একটি শিশুকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য ওই বাচ্চার নানী এবং এক নারীর কোলে তুলে নিয়ে জরুরি বিভাগে যাওয়া এবং বাচ্চাটিকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার কিছু ফুটেজ পাওয়া গেছে। তবে বের হওয়ার কোনো ফুটেজ পাইনি।’ পরিচালক বলেন, ‘আনসারদের কাছ থেকে  জেনেছি, অনেক সময় বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে বহির্বিভাগের ১০ টাকার টিকিটের ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে বাচ্চা নিয়ে বের হয়ে যায়। পরিচালক আরও বলেন, ‘ঘটনার সময় ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ, নার্স, ওয়ার্ড বয়, ওয়ার্ড মাস্টার ও আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
চোর শনাক্ত করলেন নারী
ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধারণ করা আগের ছবি দেখে চোর শনাক্ত করেছেন নবজাতকের নানী গুলে নূর বেগম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের রুমে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার সময় তিনি চিৎকার করে বলেন ‘এইটে আমার নাতনি। এইটা চোর।’ তখন বার বার তাকে দেখানো হয়।
এরপর হাসপাতালের উপ-পরিচালক মুশফিকুর রহমান কর্মচারীদের জেরা করলে তারা দাবি করেন ওই নারীকে চেনে না কেউ।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
বাচ্চা চুরির ঘটনাটি ছুঁয়েছে উচ্চ আদালতকেও। কারা এই ঘটনায় জড়িত তা বের করার নির্দেশ দেন বিচারিক তদন্তের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের অবকাশকালীন বেঞ্চ। আদেশে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে নির্দেশ দেওয়া হয় ও চার সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এছাড়া তদন্ত চলাকালে ওই শিশুর পরিবারকে নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে আগামী ২০ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান আদালত।
এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ মতো হারিয়ে যাওয়া নবজাতকের পরিবারের সদস্যদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
অবশেষে উদ্ধার
বেশ কদিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রুনা  আক্তার। তার নারী ছেঁড়া ধনকে গাজীপুর থেকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব। এরপর তাকে দেখার জন্য, তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে রুনার দুঃসহ অপেক্ষার মধ্য দিয়ে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পরিচালক রোম্মান মাহমুদ জানান, গাজীপুরের টঙ্গী এলাকা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেন তারা। রহিমা নামে সন্তানহীন একজন নারীর কাছে শিশুটিতে বিক্রি করা হয়েছে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পারভীন নামের এক আয়া এই কাজ করেছে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone