বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » বিশেষ সংবাদ » আলোর মুখ দেখছে না গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প ৯ বছরেও

আলোর মুখ দেখছে না গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প ৯ বছরেও 

রোকন উদ্দিনঃ  অনুমোদনের ৯ বছরেও আলোর মুখ দেখছে না গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প। ফারাক্কার ক্ষতি ঠেকাতে পাংশায় হতে পারে গঙ্গা তথা পদ্মা ব্যারেজ। সরকারের ভিতরের ভারতীয় এজেন্টদের বিরোধিতার কারণে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের ফাইল বারবার লাল ফিতায় আটকে আছে। অনুমোদনের ৯ বছর পরেও আলোর মুখ দেখছে না কথিত গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প।
ফারাক্কার ক্ষতি ঠেকাতে পাংশায় হতে পারে গঙ্গা তথা পদ্মা ব্যারেজ। সরকারের ভিতরের ভারতীয় এজেন্টদের বিরোধিতার কারণে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের ফাইল বারবার লাল ফিতায় আটকে আছে।
ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি এবং সিল্ট ফ্লাসিংয়ের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি-ভাগীরথী নদীতে ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা আঁটে। এজন্যই গঙ্গা নদীর উজানে ফারাক্কা নামক স্থানে এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। আর ১৯৭৫ সালে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এবং চালুর পর থেকে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এই ব্যারেজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হয়।

gonga

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন সরকারের সাথে ভারত গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে- এই পরিমাণ পানি ভারত বাংলাদেশকে দেয় না এবং চুক্তির গ্যারান্টি ক্লোজ পর্যন্ত মেনে চলে না। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নির্ভর নদীগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়ে। দেখা দেয় মরুময়তা। পরিবেশেও এর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়।
এতে করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। বর্তমানে ফারাক্কার প্রভাবে এদেশের ৫ কোটি মানুষ গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা নির্ভর প্রায় ৪৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার গৃহস্থালির পানি সরবরাহ, কৃষি, মৎস্য, বনজসম্পদ, নৌচলাচল, শিল্প কারখানা এবং সুন্দরবনসহ দেশের এক তৃতীয়াংশ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার।
এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে ইতঃপূর্বে ভারত একাধিকবার আপত্তি দিয়েছে। ভারতের আপত্তির কারণে এরকম একটি ব্যারেজ নির্মাণের কাজ বেশি দূর এগুতে পারেনি। একই কারণে কোনো ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাও এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়নি। এরপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড এই প্রকল্পের হাল ছাড়েনি। দেশকে এই করুণ পরিণতির কবল থেকে রক্ষার জন্যই পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
‘ফিজিবিলিটি স্টাডি এন্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারেজ প্রজেক্ট’ নামক এই প্রকল্পটি চারদলীয় জোট শাসনামলে ২০০৫ এর ১৮ এপ্রিল অনুমোদন হয়। ডেভেলপম্যান্ট এন্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট নামক একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই ব্যারেজ নির্মাণে চূড়ান্ত সমীক্ষা পরিচালনার কাজটি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিশেষজ্ঞরাও জড়িত। সমীক্ষা বাবদ ব্যয় হয় ৪০ কোটি টাকা।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে ওয়ারপো এবং যৌথ নদী কমিশন ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছিল। ১৯৬১ সাল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে। প্রকল্পটি যাতে না হয় এ লক্ষ্যে জিয়ার শাসনামলে ভারত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রস্তাবও রেখেছিল।
ওই প্রস্তাবনায় ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে যোগিগোপা ব্যারেজ করে ২০০ মাইল লম্বা খালের মাধ্যমে ১ লাখ কিউসেক পানি নিয়ে ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ফেলার কথা বলেছিল। আধা মাইল চওড়া এই সংযোগ খালটি গভীরতা ধরা হয়েছিল ৩০ ফুট। শুকনা মৌসুমে যেখানে ব্রহ্মপুত্রে ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকে সেখান থেকে ১ লাখ কিউসেক পানি নেয়া হলে এই নদীর অবস্থা গঙ্গার চেয়েও ভয়াবহ হবে এটা আঁচ করতে পেরেই ওই সময় ভারতীয় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘গড়াই নদী পুনঃখনন’ প্রকল্পটি ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত হয়। এই প্রকল্পটি বিগত সরকার ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয় করেও শেষ করতে পারেনি। নেদারল্যান্ড ও বিশ্ব ব্যাংক বিগত সরকারকে দিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের বিকল্প হিসাবে গড়াই নদী পুনঃখনন প্রকল্প গ্রহণ করিয়েছিল।
ফারাক্কার ভয়াবহতা কাটিয়ে তুলতে ১৯৮০ সালে জিয়া তালবাড়ীয়ায় এই প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তিতে বেশ কয়েকটি সমীক্ষার পর পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশ মালায় বলা হয়, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গড়াইসহ ১৬টি নদী নাব্যতা ফিরেও পাবে। সেইসাথে দূর হবে এই অঞ্চলের লবণাক্ততার আগ্রাসন এবং ফিরে আসবে ফারাক্কার প্রভাবে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
গঙ্গা ব্যারেজের প্রথম সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৬১ সালে অক্টোবরে। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা ‘মেজর প্রজেক্ট অন দ্য গ্যাঞ্জেস’ শীর্ষক এই সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে ১৯৭০ সালে তৎকালীন যালিম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গঙ্গা ব্যারেজের প্রাথমিক কাজের জন্য ৫ কোটি টাকা (রুপি) বরাদ্দ করেছিলো। হার্ডিজ ব্রীজের আড়াই মাইল ভাটিতে এই ব্রীজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে গঙ্গা ব্যারেজ সার্কেল গুটিয়ে ফেলা হয়েছিল।
এরপর থেকে ফারাক্কার বিকল্প ‘গঙ্গা ব্যারেজ’ নির্মাণ কাজ সরকার এখনো শুরু করেনি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু এই কাজ কবে শুরু হবে নতুন করে তার দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে প্রকল্পটির সমীক্ষা চলাকালে একাধিকবার বলা হয়েছে, রিপোর্ট পেশ করা হলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করবেন।
জানা গেছে, সমীক্ষা শেষে রিপোর্টও পেশ হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করে তা অনুমোদনের জন্য ২০১৩ সালে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। এই এলাকার মানুষের প্রশ্ন কবে শুরু হবে এই প্রকল্পের কাজ? সরকার দেশের উন্নয়নে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করলেও এই প্রকল্পটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর অন্যতম বলে মনে করেন দেশের পানি বিশেষজ্ঞরাও। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৩২ হাজার কোটি টাকা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরকম জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিতে আশ্বাসও দিয়েছে মালয়েশিয়া ও চীন সরকার। রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। ব্যারেজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের আদলে। ব্যারেজ থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকবে বিশাল রিজার্ভার। যার পানি ধারণ ক্ষমতা থাকবে ২৯শ’ মিলিয়ন মিটার কিউব। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারেজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা গেছে, ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ছাড়া হবে। এর ফলে পদ্মা নির্ভর ১৬টি নদী শুষ্ক মৌসুমে ফিরে পাবে নাব্যতা। সেই সাথে গঙ্গা অববাহিকার ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি সরাসরি সেচের আওতায় চলে আসবে।
আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই ব্যারেজ নির্মাণ সম্ভব বলে ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২১শ’ মিটার। এর গেট থাকবে ৯৬টি। ফিস পাস থাকবে ২টি এবং নেভিগেশন লক থাকবে ১টি। এছাড়াও থাকবে একটি পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখান থেকে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এই ব্যারেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে ১২ মাসই পানির প্রবাহ কন্ট্রোল করা যাবে।
এই প্রকল্প থেকে বছরে ৭ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা আয় আসবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই আয় আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এই প্রকল্পে করা বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় লাগবে মাত্র ৫ বছর। প্রকল্পটির গ্রস এরিয়া ৫১ লাখ হেক্টর। যা দেশের মোট এলাকার ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে ২৯ লাখ হেক্টর জমি কৃষি কাজে এবং ১৯ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হবে। যার ফলে বছরে ২৫ লাখ মেট্রিক টন বাড়তি ধান এবং ১০ লাখ টন অন্যান্য ফসল উৎপাদন হবে।
মৎস্য উৎপাদন হবে ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এই প্রকল্পটি না হওয়ার কারণে প্রতি বছর ১১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন কারণে। এছাড়াও প্রতি ৫ বছর অন্তর যে খড়া দেখা দেয় এতে করে গঙ্গা নির্ভর এলাকার মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক দুরবস্থা নেমে আসে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যেখানে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি পাবে, সেখানে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়ায় চাষাবাদের এলাকার পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে মোট জমির ১৬ শতাংশ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গড়াই, হিসনা, চন্দনা ও জিকে পাম্পের জন্য ৭শ’ কিউবিক মিটার, গড়াই হাইড্রোপাওয়ারের জন্য ৩শ’ কিউবিক মিটার এবং গঙ্গা ব্যারেজের জন্য ১ হাজার কিউবিক মিটার মোট ২ হাজার কিউবিক মিটার পানি গঙ্গা নির্ভর এলাকাসমূহে পৌঁছে দেয়া হবে। এই পানি পৌঁছানো হবে ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে।
যা দেশের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসবে। দেশ রক্ষা পাবে মরুময়তা ও লবণাক্তের কবল থেকে। পরিবেশে ফিরে আসবে ভারসাম্য। ব্যারেজটি নির্মাণ হলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone