বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জানা-অজানা » বিভিন্ন ধর্মে অধিকার পিতা-মাতার

বিভিন্ন ধর্মে অধিকার পিতা-মাতার 

1389453832.

এই দেশ এই সময়, ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি, সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ নচিকেতার এ গান শুনে হয়তো অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। কিন্তু তারপরও এটাই সত্য, দেশে এ ধরনের ছেলের সংখ্যা বাড়ছে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে অনেকেই এখন আর পিতামাতার নিয়মিত খোঁজখবর নেন না। ভরণ-পোষণ তো দূরের কথা। সেই দুষ্টু প্রকৃতির অবাধ্য ছেলে-মেয়েদের বাধ্য করতে পিতা-মাতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেষ পর্যন্ত আইনের পথ বেছে নেয়া হয়েছে। ২৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে পিতা-মাতা ভরণ-পোষণ বিল-২০১৩। মা-বাবা একটি বটবৃক্ষের ছায়া, মা-বাবা হচ্ছে একটি আকাশজোড়া ছাদ। প্রশ্ন জাগে- যারা জন্মের পর থেকে আমাদের লালন-পালন করে বড় করে মানুষের মতো মানুষ বানিয়েছে, মা কত কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে আজ সেই বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের জন্য সংসদে বিল এনে আইনে রূপান্তর করতে হচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে। আমরা কি কারও সন্তান নই?
বিলে বলা হয়েছে, ভরণ-পোষণ নীতি করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নীতি করতে হবে। কোনো সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস বা অন্য কোথাও বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তান তার পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। তারা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। এ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাস জেলের বিধান রাখা হয়েছে।
পিতা-মাতাকে যথাযথ সম্মান দেয়া এবং তাদের অধিকার নীতি করে লালন-পালনে সচেষ্ট থাকতে পারায় একজন সত্যিকারের মানুষের গুণাবলি ফুটে ওঠে। প্রত্যেক সন্তান তার পিতা-মাতার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবেন এমনটি স্বাভাবিক। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সহনশীল ও নমনীয় জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে এ রকম দেখা গেছে, যেখানে সন্তান নানা প্রলোভনে পড়ে বাবা-মাকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। বিভিন্ন জনের প্ররোচনায় সম্পর্ক ছিন্ন থেকে শুরু করে দায়দায়িত্ব নিতেও অস্বীকৃতি জানায়। যেসব দায়দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে সন্তানের পালন করার কথা, আজ তা বাস্তবায়ন করতে সংসদে বিল পাস করতে হচ্ছে। এ লজ্জা আমার, এ লজ্জা আপনার, আমাদের সবার। প্রথমে ঠিক করতে হবে আমাদের মানসিকতা-মানবিকতা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই, ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিল, ২০১৩’ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেন বাবা-মায়ের আকুতিতে বঞ্চিতের হাহাকার না ফুটে ওঠে।
আর একটি দিক খেয়াল রাখতে হবে- যারা সমাজের বিত্তশালী সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে উদ্যোগী হয়ে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করে বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের বাসস্থানের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, তাদেরও এই আইনের আওতায় আসা উচিত। এরপর থেকে নতুন করে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা উচিত হবে না। আর বর্তমানে যে পিতা-মাতা বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন তাদের এ আইনের আলোকে পরবর্তী কী অবস্থানে থাকবে, আসলে কি তারা বর্তমান বাসস্থান বৃদ্ধাশ্রমেই থাকবেন না তাদের সন্তানদের কাছে চলে যাবেন এটিও আইনে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সর্বোপরি আমরা সরকারকে বলতে চাই, সংসদে বিল উত্থাপন বা আইন করাটাই কোনো সমাধান নয়। এর যথাযথ বাস্তবায়নেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কত হতভাগা সেই বাবা-মা, যে তার সন্তানের কাছে অবহেলার শিকার হন! এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাবা-মার প্রতি করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতেও বিভিন্ন প্রচারণা ও সম্মিলিতভাবে কাজ করা উচিত, যেন আপনাআপনি ভেতর থেকে ওঠে আসে বাবা-মার প্রতি দায়িত্ববোধ; যা একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্যও ইতিবাচক। আমরা আর দেখতে চাই না কোনো পিতা-মাতা বৃদ্ধাশ্রমে। ছোট সময় যেমন পিতা-মাতা আমাদের লালন-পালন করেছেন, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে সেভাবেই লালন-পালন করব।
সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালোবাসা, তা পৃথিবীর একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সন্তানের জন্য বাবা-মা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাই তাদের সম্মান করা, ভালোবাসা ও তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, কালপরিক্রমায় আমরা হয়ে ওঠি অতি নির্মম। প্রকাশ পায় বাবা-মায়ের প্রতি চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা। বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, তখন তারা সন্তানের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল ও চরম অসহায় হয়ে পড়েন। আর তখন থেকেই আমরা তাদের প্রতি প্রদর্শন করি ঔদাসীন্য ও অবহেলা। তাদের ভাবতে থাকি পরিবারের বোঝাস্বরপ। এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকেই আমরা তাদের জোর করে পাঠিয়ে দিই বৃদ্ধাশ্রমে। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের ছেলেমেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার। আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক চরম অসহায় জীবনযাপন করেন তারা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে সন্তানকে মানুষ করার জন্য বাবা-মা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, যে সন্তানের সুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই নরাধম সন্তানের দ্বারাই বাবা-মা নিগৃহীত হচ্ছেন।
আমরা একবারও ভাবি না যে, আমাদের সন্তান আমাদের কাছে যেমন, আমরা ও আমাদের বাবা-মায়ের কাছে তেমন। আমরা আমাদের সন্তানকে যেমন আদর-সোহাগ করি, মায়া-মমতা দিয়ে পরম যতেœ লালন-পালন করি, আমাদের বাবা-মাও আমাদের মায়া-মমতা দিয়ে, আদর-স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। বাবা-মা নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। আমাদের সুখের দিকে তাকিয়ে তারা আরামের ঘুম হারাম করেছেন। আমাদের মুখে দুু’মুঠো খাবার তুলে দেয়ার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। আমাদের লালন-পালনে কষ্ট মনে করে কোনো শিশু আশ্রমে আমাদের পাঠিয়ে দেননি।
ইসলাম বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের সেবা-যত্ন করা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের কথা মান্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, তাদের কথা অমান্য করা নিঃসন্দেহে অনেক বড় গুনাহ। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করতে ও বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)।
হাদিস শরিফে এসেছে, একবার জনৈক সাহাবি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে জিহাদে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা প্রকাশ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা-মা কেউ কি জীবিত আছে, সাহাবি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাড়িতে গিয়ে তাদের সেবা কর। (বোখারি : ২৮৪২)। অন্য হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মা উভয়কে অথবা তাদের একজনকে পেল, অথচ সে জান্নাত আদায় করতে পারল না, তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে?
বাবা-মা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন তাদের প্রতি দায়দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়, তাদের সেবা-শুশ্রƒষা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ মানুষ যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয় তখন সে আবার শৈশবে ফিরে যায়। বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক শেক্সপিয়র বার্ধক্যকে আখ্যায়িত করেছেন দ্বিতীয় শৈশব হিসেবে। তাই তখন তার বেঁচে থাকার জন্য শিশুকালের মতো আদর-স্নেহ, মায়া-মমতার প্রয়োজন হয়। বার্ধক্যের কারণে বাবা-মায়ের মেজাজ কিছুটা খিটখিটে ধরনের হয়ে যেতে পারে, সামান্য বিষয় নিয়ে তুলকালাম কা- ঘটাতে পারেন। তাই তাদের অস্বাভাবিক আচরণকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের একজন বা উভয়েই জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের উফ বলো না। তাদের ধমক দিও না, তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone