বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » এভিয়েশন » ইউক্রেনের পথে আমার দেখা

ইউক্রেনের পথে আমার দেখা 

biman

এইদেশ এইসময়, ডেস্ক : সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছেলে আমি। চোখে পাহাড়সম স্বপ্ন,স্বপ্ন দেখায় কোন যৌক্তিকতার বালাই নেই। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে বিদেশে পড়ব এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে ২৬ শে ডিসেম্বর ফ্লাইটও ঠিক।দুঃখের বিষয় যে দেশটাতে যাচ্ছি সে দেশটার সাথে আমার দেশের মানুষের বিশেষ কোন পরিচয় নেই। কেউ চিনতে পারে আর কেউ চিনে না। দেশটির নাম ইউক্রেন। আমিও দেশটির নাম প্রথম শুনেছিলাম ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপে, বিশ্বকাপ খেলুড়ে একটা দেশ হিসেবে।

এটি ইস্টার্ন ইউরোপের একটি দেশ।এটি প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটী অংশ ছিল এবং ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।স্বাধিনতার বয়সে নবীনতম একটি দেশই বটে এবং অর্থনীতিও উন্নয়নশীলদের কাতারের উপরের দিকে পড়ে।দেশটি আয়তনে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহওম।প্রথম রাশিয়া তারপর ইউক্রেন।

বাংলাদেশে শেষ রাত, নতুন কোন দেশে প্রথম দিন আর জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমন সব মিলিয়ে মিশ্র এক অনুভূতি।তাই সে রাতে খুব একটা ঘুম হল না স্নায়ু চাপে। সব গোছিয়ে সকালে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম। সেখানে বন্ধুবর্গ আর পরিবারের সদ্স্যদের বাংগালি জাতির চিরন্তন পরিচিত আবেগঘন পরিবেশের পর্ব পেরিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে পা বাড়ালাম। আমার সহযাত্রী আমার আপনতম একজন বন্ধু। যারা দেশ বিদেশে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্টে এয়ারপোর্টে চলাচল করেন এটা তাদের জানার কথা যে এয়ারপোর্টের ছোট বড় ভোগান্তির কথা।আমাদের চড়ুইসম ভীতিপ্রবন হৃদপিন্ডকেও এই আঘাত সহ্য করতে হল।

আসলে আমি বা আমরা যে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে পড়েছিলাম সে আমার গন্তব্যের শহরের নাম(খারকিভ) জীবনে এই প্রথম শুনেছিলেন। তাই তিনি তাদের বড় কর্তার কাছে আমাদের পাঠালেন। বড় কর্তা আমাদের কাগজপত্রের বৈধতা আর আমাদের ছোট্ট একটা পরিচয় দেখে অগ্নিমূর্তি ধারন করলেন সেই অফিসারের প্রতি।উনি বললেন, “বয়েস কাম উইথ মি” উনার সাথে অফিসারের কাছে যেতেই তিনি অফিসারকে বললেন “দে আর নটরডেমিয়ান ,দে কান্ট বি ফ্রড, আই এম অলসো এ নটরডেমিয়ান,এই আসনে বসতে হলে আপনাকে সব আইডিয়াই রাখতে হবে, তাড়াতাড়ি তাদের সব কাজ করে দিন”
তিনি নিজে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কাজ শেষ করে দিলেন এবং বললেন “হেভ এ নাইস জার্নি ইয়াং ম্যান,বেস্ট অফ লাক”।
এয়ারপোর্টের মত এমন বৈরী জায়গায় এমন অপ্রত্যাশিত সাহায্য এবং আমার সেই পরিচয়টি যারপরনাই আমার বুকটা গর্বে ভরে দিল।

সকল ফর্মালিটিজ শেষে আমাদের আকাশযাত্রার জন্য অপেক্ষা,দৈত্যাকার ডানাওয়ালা পাখিটির পেটে ঢুকার জন্য অপেক্ষা।গন্তব্য দুবাই।কিছু সময় পর উঠে গেলাম কাংখিত সেই যানে।কপাল গুনে সিটও পেলাম জানালার সাথে।বিমান চলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে যেতে যেতেই মেইন ট্র্যাকে পৌছে চূড়ান্ত একটা গতি দিল ,কিছুদূর যেতেই বিমানটি আকাশে উঠে গেল।আমি উপর থেকে প্রিয় ঢাকাকে দেখতে লাগলাম এবং একটা বিষয় অবাক হয়ে দেখলাম তা হল উওরা তথা সমগ্র ঢাকাকে সবুজ লাগছে ,আমার ধারনা ছিল এটি ধূসর কিংবা হলুদ লাগবে কারন ঢাকায় তেমন গাছপালা অবশিষ্ট নেই। সেই রহস্য উন্মোচন করতে করতেই মেঘের উপরে উঠে গেলাম আর প্রানের ঢাকা নিমিষেই মিলিয়ে গেল।বুকের একটা পাশে যেন চিনচিন ব্যথাও অনুভব করলাম।

৬ঘন্টা সম্ভাব্য সময় দুবাই পৌছার।সকল কিছু পার করে আমরা দীর্ঘ সময় একটা সমুদ্রের উপর দিয়ে ভেসে চলছিলাম।সমুদ্র যেন আর শেষই হচ্ছেনা।সমুদ্রের মাঝে মাঝেই একটা দুইটা জাহাজ দেখা যাচ্ছিল। উপর থেকে মনে হচ্ছিল আমি ব্রীজের উপর থেকে নদীতে ভাসমান কোন ছেড়া জুতা দেখছি।একসময় এ সমুদ্র শেষ হল আর বুঝতে পারলাম দুবাই এর তীরে এসে গেছি।এরপর মনে হল আমি অন্য এক জগতে এসে গেছি।কারন চারিদিকে কালচে সোনালি বর্ন, নেই ন্যুনতম সবুজের আভা।যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি।এরপরেই এসে গেলাম পাথরের মত এলাকায়। উপর থেকে দেখছিলাম শক্ত শক্ত পাথরের আকাশচুম্বী পাহাড়।আর তার মাঝে সাপের মত আকাবাকা আধুনিক রাস্তা ।কিছুক্ষনের মাঝেই জনবিরল রাস্তায় যেন প্রানের স্পন্দন দেখতে পেলাম, কারন সেখানে পিপড়ার মত চলমান গাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম।এরপরেই জনপদের দিকে এসে গেলাম।আধুনিক তিনতলা-চারতলা ফ্লাইওভার,মানবসৃষ্ট কৃত্রিম পরিবেশে বৃক্ষে আবৃত আধুনিকতম বাড়ি। যেখানে উপর থেকেই সেই বাড়ির প্লে গ্রাউন্ড,সুইমিংপুল তথা সেই বাড়ির আভিজাত্য ও বিলাসীতা বুঝতে পাচ্ছিলাম।

এসব দেখতে দেখতেই ছো মেরে নেমে গেলাম বিশ্বের সব বিমানের রাজধানী দুবাই এয়ারপোর্টে। নেমে দেখি এ আরেক জগত, এ যে বিমানের জগত।শত শত বিমান সিরিয়ালি দাঁড়িয়ে।এক সাইডে বিমান উঠছে অন্য সাইডে নামছে। বিমানের এ মহা কর্মযজ্ঞ দেখে কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।আমাদের বিমান একটা সাইডে দাড়াল আর দরজা খোলার পর সিড়ি লাগিয়ে দিল সেটা দিয়ে নেমে গেলাম। নেমে দেখি আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে । সেটাতে উঠে গেলাম। সেটা আমাদের গন্তব্য টার্মিনাল টু তে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। সেখানে নেমে পড়ে গেলাম এক অকূল পাথারে। কেউ কিছু বলছেনা ,কেউ কোন ডিরেকশন দিচ্ছেনা ভয়ে ভয়ে চুপচাপ দেড় ঘন্টা সেখানে বসে রইলাম,আমি জানিনা আমাকে কি কি করতে হবে।অবশেষে আমার বিমান কোম্পানীর লোগো লাগানো স্যুট পড়া কিছু লোক এসে আমাদের কড়া একটা চেক করে গাড়িতে করে ট্রানজিট টার্মিনালে নিয়ে গেল।সেখানে আমাদের প্রায় ২১ ঘন্টা থাকতে হবে। সেখানে ঢুকে দেখি সে এক আরেক জগত।এটা বিশ্বের আধুনিকতম স্থাপনা তো বটেই মনে হল বিশ্বে সকল দেশের সকল মানুষের মিলনমেলা। কোন বর্নের ,কোন জাতের এবং কোনধরনেই মানুষ নেই এখানে সেটাই প্রশ্ন। এর ভিতরে বিশ্বের সকল ব্র্যান্ডের সকল শপই আছে আধুনিকতম সংস্করনে।দোকানে খেতে যেয়ে চোখ কপালে উঠে গেল খাবারের দাম দেখে ,উঠবেইনা কেন একটা বার্গারের দাম যে ১২০০+ টাকা। আমাদের মত মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মানুষদের জন্য এ যে একসপ্তাহের বাজারের সমান।ব্যাগে থাকা খাবার দিয়েই চালিয়ে দিলাম।

যেহেতু অনেক বড় এ জায়গাটি সারারাত সেখানে ঘুরে,আড্ডা দিয়ে ,একটু ঘুমিয়ে আর নানান ধরনের মজা করে রাত পার করে দিলাম।হঠাত সামনে আবিষ্কার করলাম বিশ্বের উচ্চতম বিল্ডিং “বুর্জ আল খলীফা” মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে,আকৃতি দেখে রোমাঞ্চিত হলাম বটে।সকাল নয়টায় খারকোভের ফ্লাইট।আমি আর আমার বন্ধু ভাবছি আমরা দুইজনই বোধ হয় একমাত্র সে জায়গার যাত্রী। সময় হল আর আমরা কাউন্টারে লাইনে দাড়ালাম। আমরা দুইজনই দাড়িয়ে,ভাবছিলাম মানুষ নেই কি আর। বেশ কিছুক্ষন খেয়াল করিনি হঠাত পেছনে তাকিয়ে দেখি বিশাল বড় লাইন,জায়গাটির শেষ মাথা পর্যন্ত চলে গেছে।আবার সেখান থেকে বাসে করে বিমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বাসগুলোতে বসা যায় না সবাইকেই দাঁড়িয়ে যেতে হয়। একটা বিষয় খেয়াল করে অদ্ভূত অনুভূতি হল তা হল বাসে আমরা দুজন বাদে সবাই সাদা ধবধবে আর সবাই আমাদের কেমন যেন আড়চোখে দেখছে।যাইহোক যথারীতি বিমানের সবার সামনের জানালার পাশের সিট পেলাম।

আমাদের বিমান রানওয়েতে অপেক্ষা করছে, কারন একের পর এক বিমান উঠছে আর অনেকগুলা দাঁড়িয়ে আছে ,এ যেন বিমানের যানজট লেগে গেছে।আমাদের টার্ন এসে গেল আর আমরাও একইভাবে আকাশে উঠে গেলাম আর দুবাই এর রুপ সুধা দেখতে লাগলাম। যেহেতু খুব একটা উপরে উঠিনি সেখান থেকে বিখ্যাত বুর্জ আল আরাব,বুর্জ আর খলীফা দেখতে পাচ্ছিলাম।এ এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য আমাদের মত হতদরিদ্র দেশের অপ্রাপ্তবয়স্ক এক ছেলের জন্য।সমুদ্রের উপর এসে আরেকটা রুপ দেখে চমকে গেলাম,আর বলে উঠলাম এও সম্ভব।আমার জিওগ্রাফীতে দেখা পাম সিটি আইল্যান্ড যে দেখতে পাচ্ছি। সমুদ্রের উপর কৃত্রিমভাবে তৈরি শহর এ পামসিটি।এ রুপ দেখে আমার চোখ দুটি আমার প্রতি কৃতজ্ঞই বটে, সে যে সার্থক।

উপর থেকে খেলনা বাড়ির সমন্বয়ে যেন এক একটা লোকালয় পার হচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম বিমান এত আস্তে চলে কেনো?পরক্ষনেই সামনে মনিটরে দেখি ঘন্টায় সাড়ে নয়শ কিলোমিটার গতিতে চলছে।বুঝলাম গতি ঠিকই আছে এ আমার দৃষ্টির ভ্রম।বিমান যখন ১০০০০ মিটার এর বেশি উপরে উঠে গেল তখন এও প্রমান পেলাম পৃথিবীটা সত্যিই গোল,যা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছিলাম।

এরপর চলে এলাম সাদা বরফের পাহাড়ের রাজ্যে।ঘন্টার পর ঘন্টা চলছি নেই কোন লোকালয় নেই অন্য কোন বর্নের বর্নচ্ছটা,শুধু শ্বেতশুভ্রতা। বন্ধুকে বললাম সে সময়, “ যত পাহাড় পর্বত পাড় হয়ে যাচ্ছি এরপর আদও কি ফিরতে পারব,আমরা কি হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে চলে যাচ্ছিরে?” অবশেষে উপর থেকে সাদা পাহাড়ের ভিতরই বিশ্বের আধুনিকতম লোকালয় গুলো দেখতে পেলাম, আধুনিক এজন্যই বললাম এ যে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ। সাদা পাহাড়ের ভিতর সাপ কিলবিল করা রাস্তা সত্যিই অন্যরকম এক অনুভূতি।

এসব দেখতে দেখতেই আমার গন্তব্যস্থানের কাছাকাছি চলে আসলাম। প্লেন ল্যান্ডিংএ সমস্যা হচ্ছে প্রচন্ডরকম কুয়াশার জন্য।অবশেষে প্লেনটি ছো মেরে নিচে নেমে আসল আর আমিও উপর থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন ,ভেজা ,ডিসমাল একটা শহর দেখতে পেলাম,মনের ভেতর কেন যেন একটু এই ছোট্ট জীবনের ভ্রমনে স্বপ্নের অনেক কিছু দেখে চোখ জুড়ানোর বদলে বুকের ভিতর এক অজানা কারনে মোচড় দিয়ে ঊঠল যে মোচড়ের ব্যাথা হয়তো থাকবে আমার সঙ্গী হয়ে এ অজানা শহরে।এয়ারপোর্টের ফর্মালিটীজ শেষে বাইরে বেরিয়ে চারদিকটা দেখে মন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে এল “ওয়াও”।নিম্ন তাপমাত্রা ,পরিষ্কারতম রাস্তা,খোলা আকাশ , সুন্দর ছিমছাম বাড়ি,দোকান আর প্রশস্ত অল্প যানবাহনবাহী রাস্তা।এ টুকু বুঝলাম ইউরোপের সকল দেশের একই চেহারা,নেই কোন পার্থক্য বর্ডারের সীমারেখা বাদে।গাড়িতে উঠে নিজেই নিজেকে বললাম “ওয়েলকাম টু খারকিভ,ওয়েলকাম টু ইউক্রেন”

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone