বাংলাদেশের ‘ভার্জিন সি বিচ’
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোলে সম্প্রতি আরো একটি অনিন্দসুন্দর সমুদ্র সৈকত জেগে উঠেছে। সৈকতটি একেবারে আনকোরা, কুমারী। স্থানীয়ভাবে যাকে এখন ডাকা হচ্ছে ‘ভার্জিন সি বিচ’ বলে। সমুদ্র সৈকতটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার বঙ্গোপসারের কোল ঘেঁষা নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন দমার চরের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত।
প্রায় দশ কিলোমিটার কর্দমাক্ত পথ ভেঙ্গে মাঝে পাঁচ ছয়টা ছোট বড় খাল সাঁতরে যখন দমার চরের দক্ষিণ প্রান্তে বিডিলাইভ টিম পৌছে তখন ভর দুপুর। হঠাৎ দেখা গেল সামনে বিস্তীর্ণ এক সমুদ্র সৈকত। অগ্রহায়নের প্রখর সূর্যের সোনালী আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। বিপুল গর্জনে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে ছড়ানো সমুদ্র তটে ।
একদিকে অপূর্ব সুন্দর আর নির্জন সমুদ্র সৈকত। স্নিগ্ধ উর্মিমালা। অন্যদিকে হাজার হাজার রং বেরং এর পাখির ওড়াওড়ি, মধুর কলতান, পাড়ে শতশত গরু-মহিষের অবাধ বিচরণ। অদূরে মেঘের মত ঘন কালো বিশাল প্যারা (ম্যানগ্রোভ) বনের হাতছানি। এটা বাংলাদেশ তো! নাকি?
বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোলে সম্প্রতি জেগে ওঠা অপূর্ব সুন্দর এই সমুদ্র সৈকতের সারা শরীরে যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘ্রাণ লেগে আছে। সৈকতের ভেজা কোমল মাটিতে পা রাখতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠতে হয়। যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ কোন শিশুর তুলতুলে নরম বুকে পা রাখছি ।
অদূরে সাগরের ঢেউয়ে একদল অতিথি পাখি সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউয়ে আপন মনে দুলছে। অনেকে ঠোঁট ডুবিয়ে মাছ খোঁজায় ব্যস্ত। কারো গায়ের রং একবারে দুধ সাদা কারো বা লাল আবার কারো সাদা কালো লালের অপূর্ব মিশেল। দূর থেকে তাদের শরীরের সবটুকু দেখা যায় না
সমুদ্র সৈকতের বালুতটে ঘোরাঘুরি করছিল একদল কালো মহিষ। তাদের কেউ কেউ আমাদের দিকে কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। নাক উঁচিয়ে বাতাসে ঘ্রান নিল। যেন তাদের অবাধ এবং মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্রে নতুন কারো আগমন সহ্য হচ্ছে না। সন্দেহের দৃষ্টিতে আগন্তুককে চিনে নেয়ার চেষ্টা করছিল। আবার নিজ নিজ দলে ফিরে গেল। তাদের এই বিচলিত বোধ করার কারণ হিসেবে বোঝা গেল তারা সাধারণত রাখাল বালক আর কালেভদ্রে দু’একজন জেলে ছাড়া বাইরের কোন লোক দেখতে অভ্যস্ত নয়। কেননা এই নবীন সমুদ্র সৈকত এ পর্যন্ত বাইরের লোকের নজরের বাইরে থেকে গেছে ।
দমারচর বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত । এখান থেকে হাতিয়া উপজিলা সদরের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। নিঝুম দ্বীপের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় দমার চর। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। অপূর্ব সুন্দর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এই দ্বীপটি এখনও বাইরের মানুষের এমনকি নিঝুম দ্বীপের সাধারণ জনগনেরও অজ্ঞাত ।
অতিথী পাখির আগমনে সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জলাভূমি ইতিমধ্যেই পাখির অভয়ারন্যে পরিনত হয়েছে। জলাভূমিতে ছোট বড় মাছ রীতিমত কিলবিল করছিল। এসব মাছের লোভে আসে হাজার হাজার অতিথী পাখী। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ বেশ দূর থেকে শোনা যায়। সৈকতের যে দিকটা পানি পর্যন্ত নেমে গেছে সেখানকার মাটি বেশ শক্ত। পা দেবে যায় না। হাঁটু পানি পর্যন্ত নেমে হাঁটা এবং গোসল করা যায় নির্বিঘ্নে। সৈকতের উপরে শুকনো শাদা বালুর স্তুপ। ছড়ানো রাশি রাশি বালু ঝিকমিক করছিল রোদে। এজন্যই নিঝুম দ্বীপের লোকেরা এটাকে বলে দেইলা (সাগরটিলা)। শাদা বালুতে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার বিচরণ। তারা বালুতে গর্ত করে থাকে। মানুষের সাড়া পেলেই দ্রুত গর্তের ভেতরে ঢুকে যায় ।
নিঝুম দ্বীপের লোকজন এবং মাছ ধরতে যাওয়া লোকেরা এই নয়নাভিরাম সৈকতকে বলে ‘দেইলা’ বা বালুর স্তুপ। তাদেরকে আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে আসলে এটা একটা সমুদ্র সৈকত। যা কিনা কক্সবাজরের সমুদ্র সৈকতের চেয়েও অনেক বেশী সুন্দর এবং আকর্ষনীয়।
নিঝুম দ্বীপের কিশোর ছেলেরা দমার চরে সাধারণতঃ যায় বড় আকারের কাঁকড়া ধরার উদ্দেশ্যে। জেলেরা যায় আশপাশের নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরতে। এই সমুদ্র সৈকতটি কক্সবাজার সৈকতের চেয়েও বেশী আকর্ষনীয় এই কারণে যে, এখানে রয়েছে পাখির একটি অভয়ারন্য। অসংখ্য পাখির পাখা ঝাপটানি আর কলকাকলি মোটামুটি সারা বছরই থাকে। তবে শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত হাজার হাজার পাখির কারণে এখানে রীতিমত পাখির মেলা বসে যায়।
নতুন সৈকতটি দৈর্ঘ্যে দশ থেকে পনেরো কিলোমিটার হবে। মাঝে কিছু কিছু জায়গায় নরম মাটি আর ছোট ছোট খাল রয়েছে। ভাটির সময় এসব খাল একদম শুকিয়ে যায়। তখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। জোয়ারের সময় খালগুলি পানিতে একদম টইটুম্বুর হয়ে যায়। তবে মূল সৈকত কখনই পানিতে ডোবে না। স্থানীয়রা জানান সারা বছরই এই জায়গাটা জেগে থাকে। এমনকি বর্ষা ঋতুর ভরা পূর্ণিমাতেও সৈকতের উপরিভাগে পানি ওঠে না। সাইক্লোন বা জলোচ্ছাসের কথা আলাদা।
স্থানীয়রা জানান একমাত্র দশ নাম্বার মহা বিপদ সংকেত ছাড়া অন্য কোন সময় তারা দেইলা বা সাগর টিলা ডুবতে দেখেননি। তারা জানান, দমার চরের বয়স অনেক হলেও এই দেইলা বা বালুর স্তুপের বয়স বেশী না। মাত্র ২০০৫ সাল থেকে এখানে বালু জমতে শুরু করে। সাগরের পানিতে বালু এসে জমতে জমতে বর্তমানে একটি সি বিচের রূপ লাভ করেছে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তিনি দমার চরের নাম শোনেননি। তবে নিঝুম দ্বীপের কথা শুনেছেন এবং সেখানে পর্যটন সংক্রান্ত কিছু স্থাপনা নির্মানের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে তিনি জানান।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিনকে দমার চরের সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা জানালেন। তিনি বলেন, দমার চরের দক্ষিণপ্রান্তে সাগরের পানিতে ভেসে আসা অনেক বালু জমে আছে যা দেশের অমূল্য সম্পদ। তিনি এই বালু আহরণের জন্য সরকারকে বিভিন্ন সময় অনুরোধ করেছেন বলে জানান। সরকার তার কথায় কর্ণপাত করেনি বলে দুঃখ প্রকাশও করলেন!
নিঝুম দ্বীপের দমারচর সমুদ্র সৈকতের এই জায়গাটি সবার অজ্ঞাতে থাকার মূল কারণ হচ্ছে এর দুর্গমতা এবং স্থানীয় জলদস্যুদের উপস্থিতি।
আশপাশের নদী ও সমুদ্রে যারা ডাকাতি এবং বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়ায় তারা লোক চক্ষুর আড়ালে থাকার জন্য এবং পুলিশের নজর এড়াতে সহজেই এই চরের নির্জন বন-জঙ্গলে এসে লুকিয়ে থাকে। তারা অনেক সময় মূল ভূখন্ড থেকে লোকজন ধরে এখানে জিম্মি করে রাখে এবং মুক্তিপন আদায় করে। এই ভয়ে সাধারনতঃ একান্ত দায়ে না পড়লে এদিকে কেউ পা বাড়ায় না। এখন যথযথ কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থা আর নিরাপত্তার দিকে একটু সুনজর দিলেই এই অপূর্ব সুন্দর সি বিচটি একটি আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।